জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক ফয়জুল হাসান খাদিমানির একটি বক্তব্য নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ রেজাউল করীমকে নিয়ে কিছু বিভ্রান্তিকর বানোয়াট তথ্য প্রকাশ করা ছাড়াও তিনি এদেশের ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করেছেন বলে দাবি করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান।
তিনি এ বিষয়ে দীর্ঘ একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে তার দেওয়া একটি দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে এদেশের ইসলামী রাজনীতি ও জমিয়ত নেতার বিষয়ে সার্বিক তথ্য তুলে ধরেছেন।
তার ফেসবুক পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
কয়েকদিন ধরে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একজন কেন্দ্রীয় নেতার একটি বক্তব্য নিয়ে ইসলামী অঙ্গনে বেশ আলোচনা চলছে। আমাদের ধারণা ছিলো, আলোচক তাঁর বক্তব্যের ভুল বুঝতে পেরে তাঁর বিতর্কিত বক্তব্য ও অসত্য তথ্য প্রদানের ব্যাখ্যা পেশ করবেন, অথবা অনুতপ্ত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেন। কারণ, একজন হক্কানী আলেমের কাছ থেকে আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।
কিন্তু বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও সন্মানীত আলোচক এর কাছ থেকে আমরা কোনরকম প্রতিকারমূলক উদ্যোগ দেখতে পাইনি। যে কারণে আজকে একটি অনুষ্ঠানে হযরত পীর সাহেব চরমোনাই তাঁর ওপর আরোপিত মিথ্যা তোহমত এর কিছু জবাব দিয়েছেন।
আলোচক শুধু পীর সাহেব চরমোনাই কেই নয় বরং গোটা আলেম সমাজকে ঢালাও ভাবে আঘাত করেছেন। তিনি বলেছেন, "যারা জমিয়ত করে না; তারা দেওবন্দের জারজ সন্তান"। দারুল উলুম দেওবন্দ কি তাহলে অবৈধ সন্তানও জন্ম দেয়? জমিয়তের প্রাণপুরুষ শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহমাতুল্লাহ আলাইহি কি এ জাতীয় সংকীর্ণ চিন্তা লালন করতেন?
এমন উদ্ভট চিন্তা যিনি লালন করেন, তিনি জমিয়তের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কেন্দ্রীয় নেতা হন কি করে; তা আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে। একজন শিক্ষক হয়ে তালিবুল এলেমদের প্রশিক্ষণের নামে এমন বাহুল্য কথা এবং অসত্য তথ্য দিয়ে তিনি কী শিখাতে চান, তাও আমাদের বোধগম্য নয়।
তিনি হযরত পীর সাহেব হুজুর কে নিয়ে যে মিথ্যাচার করেছেন, তা আজ সবার কাছেই পরিষ্কার হয়েছে।অতএব সে বিষয়ে আমি আর কিছু বলা প্রয়োজন মনে করি না।
কিন্তু ইসলামী আন্দোলন নিয়ে যে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন।
তিনি বলেছেন, ওস্তাদের সাথে বেয়াদবি করতে করতে ইসলামী আন্দোলন বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। তিনি বলেছেন, হযরত হাফিজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলন থেকে সরে এসে পীর সাহেব চরমোনাই র. শাইখুল হাদিস র. এর নেতৃত্বে আলাদা খেলাফত গড়ে তুলেছেন। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে শাইখুল হাদিস সাহেব কে বের করে দিয়েছেন এবং শুধু নেতৃত্বের লোভে পীর সাহেব চরমোনাই ইসলামী ঐক্যজোট ছেড়ে চলে গেছেন।
খাদিমানী সাহেব এসব বিভ্রান্তিকর ইতিহাসও হয়তো কোন বিভ্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে শুনেছেন এবং কোনো রকম যাচাই না করেই ছাত্রদের সামনে বয়ান করেছেন।
প্রকৃত বিষয় হলো, পীর সাহেব চরমোনাই রহঃ হযরত হাফেজ্জী হুজুরের র. জীবদ্দশায় কখনোই খেলাফত আন্দোলন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হয়ে আসেন নাই। হযরত শাইখুল হাদিস র. এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা খেলাফত আন্দোলনে পীর সাহেব চরমোনাই র. একদিনের জন্যেও যোগদান করেননি।
হযরত শাইখুল হাদিস রহ. হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. হযরত মাওলানা আব্দুর রহিম রহ. সহ আরো অনেকে মিলে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠাকালীন হযরত শাইখুল হাদিস রহ. এর খেলাফত আন্দোলন এবং অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে ইসলামী যুব শিবির ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত ছিল । কিন্তু ১৯৮৮ সালে খেলাফত আন্দোলন এবং যুব শিবির মিলে ঔক্যবদ্ধ হয়ে খেলাফত মজলিস নাম ধারণ করে এবং এক পর্যায়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যায়। শাইখুল হাদিস র.ও এক সেশন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর নেতৃত্বের লোভে পীর সাহেব চরমোনাই রহ. ইসলামী ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে গেছেন একথাটাও একেবারেই অমূলক।
মূলত ইসলামী ঐক্যজোট গঠিত হয়েছিল যে নীতিমালার ভিত্তিতে সেই নীতিমালায় উল্লেখ ছিল ২ বছর অন্তর অন্তর জোটের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে। সে আলোকে ১৯৯৩ সালে ইসলামী ঐক্যজোটের মজলিসে শুরায় খেলাফত মজলিস ছাড়া অন্য সকল শরিক দল পীর সাহেব চরমোনাই রহ. কে চেয়ারম্যান হিসেবে প্রস্তাব করে। অপরদিকে খেলাফত মজলিস শাইখুল হাদিস সাহেব ছাড়া অন্য কাউকে চেয়ারম্যান হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। অপর শরিক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম শাইখুল হাদিস সাহেব র. চেয়ারম্যান থাকলে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। চরম অচলাবস্থা দেখা দেয় ইসলামী ঐক্যজোটে। এমন অবস্থা কিছুদিন চলার পর অধিকাংশ শরিক দলের অনুরোধের প্রেক্ষিতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোট টিকিয়ে রাখার স্বার্থে পীর সাহেব চরমোনাই র. ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন । কিন্তু তাতে খেলাফত মজলিস জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পীর সাহেব চরমোনাই র. বিষয়টিকে সুরাহার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব শাইখুল হাদীস রা. এর কাছে হস্তান্তর করেন।
কিন্তু জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম শাইখুল হাদীস সাহেব রহ. কে চেয়ারম্যান মেনে নিতে না পেরে জোট থেকে বেরিয়ে যায়। ১৯৯৪ সালের পর থেকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম আর ইসলামী ঐক্যজোটে ফিরে আসেনি। কিন্তু ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোটে যোগদান এর আগ পর্যন্ত ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গেই ছিল। মূলত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামই প্রথম ইসলামী ঐক্যজোটে বিচ্ছিন্নতার সূচনা করে।
হযরত হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলন থেকেও সর্বপ্রথম মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী র. এর নেতৃত্বে জমিয়তের একটি গ্রুপ বের হয়ে গিয়ে বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার সূচনা করেছিল। খাদিমানী সাহেবরা কোমলমতি ছাত্রদেরকে ইতিহাসের ভুল শিক্ষা না দিলে, আমাদেরকে অতীতের এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হতো না।
খাদিমানী সাহেবদের উচিত, অন্যদের নিয়ে খোঁচাখুঁচি না করে জমিয়তের মতো শতবর্ষী একটি ঐতিহ্যবাহী দলকে তারা যে খাদে ফেলে দিয়েছেন, তা থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করা।
আরও পড়ুন :
শিক্ষাজীবনে কোনো ক্লাসে পাশ করেননি চরমোনাইর পীর : বিতর্কিত সেই জমিয়ত নেতা
‘যে জমিয়ত করে না, সে দেওবন্দের জারজ সন্তান’ জমিয়ত নেতার এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া