পলাশ রহমান
নিউজিল্যান্ডের মসজিদে জঙ্গি হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কেউ একজন পাগল হয়ে গেল বা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে মানুষ হত্যায় ঝাপিয়ে পড়লো, বিষয়টা একেবারেই এমন নয়। হামলাকারীদের সুনির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য আছে, লক্ষ আছে। তারা মাথার ভেতরে একটা মতবাদ লালন করে। আর তা হলো ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদ। যার আরেক নাম- গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট।
গ্রেট রিপ্লেসমেন্টের উদ্ভাবক ফ্রান্সের একজন সাহিত্য এবং শিল্পতত্ত্ব বিশারদ। ইহুদিদের সহযোগিতায় সে এক বিশাল মেনিফেস্টো প্রকাশ করেছে, যার মূল বক্তব্য হলো- হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি। (শিল্প সাহিত্যের মানুষদের সাধারণ ভাবে উদার মনের মানুষ মনে করা হয়। কিন্তু বৈশ্বিক পরিবর্তনের ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে শিল্প সাহিত্যমনা মানুষদের মগজেও ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদ বাসা বেঁধেছে)
হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি বা সাদা চামড়ার শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসীদের সাদা চোখে নিছক বর্ণবাদী মনে হলেও এই মতবাদের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর রকমের মুসলিম বিদ্বেষ। তারা মনে করে পৃথিবীতে সাদা চামড়ার মানুষরাই শ্রেষ্ঠ এবং তাদের খ্রিষ্টান ধর্ম হলো এলিট ধর্ম। যা অন্যসব ধর্মের উর্দ্ধে। বিশেষ করে মুসলমানদের ধর্ম হলো নিচু শ্রেণীর ধর্ম। অনেকটা হিন্দুদের জাত বৈষম্যের মতো।
হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি বা আধুনিক এই জঙ্গি মতবাদে যে শুধুমাত্র বিশেষ একটি গোষ্ঠি বিশ্বাস করে এবং সুযোগ পেলে কালো চামড়ার মানুষেদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, মুসলমানদের হত্যা করে বিষয়টা মোটেও এমন নয়। অভিন্ন হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি মতবাদে বিশ্বাসী বহু মানুষ এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার চেয়ারে বসে আছে। যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমেরিকা ফাস্ট। ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী মাত্তেয়ো সালভিনি বলেন, প্রিমা ইতালিয়া। তাদের এসব কথা বা বিশ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর রকমের জঙ্গি মতবাদ হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি। এই মতবাদিরা নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করে। যেমন, ডেঞ্জারাস আইডিওলজি। এই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করে তারা মূলত ইসলামি আদর্শকে ইঙ্গিত করে।
হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি মতবাদিদের মেনিফেস্টো হলো গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট। যা নিজের হত্যা মিশনের মেনিফেস্টো হিসাবে প্রকাশ করেছে অষ্ট্রেলিয়ান ভয়ঙ্কর জঙ্গি ব্রেন্টন ট্যারান্টো।
হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি মতবাদীদের অন্যতম টার্গেট হলো মুসলিম অভিবাসীরা। তারা মনে করে মুসলিম অভিবাসীরা অধিক হারে সন্তান জন্ম দেয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হুমকি। তারা বিশ্বাস করে কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষদের জন্ম হয়েছে দাসত্ব করার জন্য। তারা কেনো কাজে কর্মে, ব্যাবসা বাণিজ্যে, জ্ঞান বিজ্ঞানে চালকের চেয়ারে বসবে?
হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি মতবাদিদের মধ্যে যারা একটু উদার চিন্তা করে বা অধিক মাত্রায় কৌশলী তারা সরাসরী সাদা কালো বা মুসলিম খ্রিষ্টানের প্রশ্ন এড়িয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার কথা বলে। তারাও অ্যান্টি-মাল্টিকালচারিজমের নামে অ্যান্টি-ইসলামিজম লালন করে। তারা মুখে মুখে কালচারাল ইন্টিগ্রেশনে অবিশ্বাসের কথা বললেও ভেতরে ধারন করে অ্যান্টি-ইসলামিজম। পৃথিবীর অন্য কোনো সংস্কৃতিতে তাদের এলার্জি না থাকলেও মুসলিম সংস্কৃতি তাদের চোখের বিষ।
হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি মতবাদিদের মতো অ্যান্টি-মাল্টিকালচারিজমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে গিয়ে মুসলিম সংস্কৃতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। তারা চায় পশ্চিমের দেশে বসবাসকারী মুসলমানরা মুসলিম সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে পশ্চিম সংস্কৃতির আদলে ধর্ম পালন করবে। যে কারনে পৃথিবীর অনেক দেশে মুসলিম নারীদের বোরখা বা হিজাব ব্যবহারে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। অনেক দেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার জন্য সরকারের উপর চাপাচাপি করা হচ্ছে। আমরা দেখেছি, ইতালির উপপ্রধানমন্ত্রী অভিবাসীদের লক্ষ করে বলেছেন, ইতালিতে থাকতে হলে ইতালিয় সংস্কৃতি মানতে হবে। শুকরের মাংশ খেতে হবে। লাল মদ পান করতে হবে। এগুলোর কোনোটাই হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি মতবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
নিউজিল্যান্ডের মসজিদে জঙ্গি হামলা করে মানুষ হত্যা ঘটনায় বিশ্বজুড়ে যেমন নিন্দার ঝড় উঠেছে, একই ভাবে কেউ কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে ওই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করছে। যা অষ্ট্রেলিয়ার একজন সিনেটরের বক্তব্যে পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠেছে। ওই সিনেটর হয়তো মনের কথা মুখে প্রকাশ করে বিতর্কে পড়েছেন, কিন্তু তার মতো অনেক ক্ষমতাধর মানুষ আছে যারা মুখে প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে অভিন্ন মতবাদ লালন করে এবং প্রশ্রয় দেয়।
আমরা দেখেছি, নিউজিল্যান্ডের জঘন্য জঙ্গি হামলা নিয়ে গোটা দুনিয়ার মানুষ যখন উদ্বেগ প্রকাশ করছে, ঠিক তখনি ইজরায়েলের জঙ্গিবাদীরা ফিলিস্তিনের অন্তত একশ জায়গায় বোমা ফাটিয়েছে। শিশু নারী থেকে শুরু করে সব ধরনের নিরীহ মানুষ হত্যার মিশন চালু রেখেছে। সন্ত্রাসবাদ নিধনের নামে ইউরোপ আমেরিকা যৌথ ভাবে আরব বিশ্বে টনটন বোমা ফেলে মুসলিম জনপদ ধ্বংশ করেছে। এসব জঙ্গি হামলার আড়ালে রয়েছে ওই অভিন্ন হোয়াইট সুপ্রিম্যাসি। এর ফলে দেশে দেশে ‘হেইট ক্রাইম’ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মতো গোটা ইউরোপ জুড়ে মুসলিম অভিবাসীরা জঙ্গি হামলার আতঙ্কে বসবাস করছে।
অভিজ্ঞজনরা মনে করেন আমাদের দেশেও ‘হেইট ক্রাইম’ বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। যে মাত্রায় রাজনৈতিক সহিংসতা, প্রতিহিংসা বৃদ্ধি পেয়েছে, ভিন্নমত অন্যমত দমন করার অশুভ সংস্কৃতি চাল হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে মানুষ ঘৃণাসঞ্জাত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে। প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠতে পারে। যা কোনো ভাবেই প্রিয় মাতৃভূমির জন্য শুভ বার্তা বহন করে না।