সাইফ সিরাজ
গভীর রাত। দিনের মুখরতা থেমে রাতের নিরবতা ঝেঁকে বসার কথা। আমাদের এই তল্লাটে নেমে এসেছে হাহাকার আর তীব্র আর্তনাদ। রাতের নিরবতা এখন আমাদের কাছে ইতিহাস। অবশ্য কেউ কেউ মুখর আনন্দে আছে। এরা ভীষণ ধৈর্যশীল। আমাদের তল্লাটে এরা ভিন্ন মানুষ। এরা নির্ঘুম-নির্মোহ থাকে। নির্ভার থাকে। এদের ক্ষমতা দেখে নিজেকে অসহায় মনে হয়। ভীষণ অসহায় মনে হয়। মনে হয় আমি হয়তো অসামাজিক। অথবা ঠিক যুগে আমার আগমণ হয়নি! পরক্ষণেই দেখি, আমার মত অনেকেই নিজেকে অসহায় মনে করে। অনেকেই সময়কে বেয়াড়া বলে, যুগের বাতাসকে নিয়ন্ত্রণহীন ভেবে নিজেরে ভেতর নিজেই গোমরে মরে। নতুন আলোর প্রত্যাশায় প্রতিটি রাতের কোলে নিজেকে সঁপে দেয়। হাহাকার আর গমকপূর্ণ রাত একসময় শেষ হয়। কিন্তু রাতের অন্ধকার শেষ হয় না। আলোর আগমণ হয়ে থাকে সুদূরপরাহত।
বলছিলাম রাতের হাহাকার আর আর্তনাদের কথা। হ্যাঁ আমাদের তল্লাটে চোখ মেললেই রাত আলোকিত হয়। কান পাতলেই সেই আলোর ভেতরের আর্তনাদ আর হাহাকার শুনা যায়। আমরা ভীষণ ভয় পাই। আমরা আমাদের অনাগত প্রজন্মের জন্য একটা আগুণের তাওয়া দেখতে পাই। একটা কঠিন জীবনের আগমণধ্বনি আমরা শুনতে পাই। এসব কারো কাছে বলতে পারি না। কেউ আমাদের পাত্তা দেয় না। আবার আমরা যারা এই তল্লাটের দুঃখ-সুখের সঙ্গে একাকার হয়ে যাই; আমারা খুবই দুর্বল। কিন্তু আমাদের ভেতরে আগুন আছে। প্রেম আছে। সাহস আছে। তবুও আমরা মিশে যাই।
কোথায় মিশে যাই? সেই মুখর আনন্দে থাকা, নির্বিকার-নির্ঘুম থাকা আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে। আমরা তাদের সঙ্গে খেলতে পারি না। এই তল্লাটে আমরা খেলতে আসিনি। এসেছি একটা মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। সেই উদ্দেশ্যের কথাও বলতে পারি না। কোত্থেকে যেন আমাদেরকে আতেল, বিলাসী, সেকেলে ও শত্রু বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘কোত্থেকে যেন!’ কেন বললাম? কারণ, কারা আমাদের সুন্দরকে অসুন্দরে রূপান্তর করে সেটাও জানি। বলতে চাই না। বলি না। কীসের যেন ভয়। কীসের যেন আড়ষ্টতা। ওদের সঙ্গে সহাবস্থানের তীব্র একটা আকর্ষণ। তীব্র একটা মোহ। হৃদয় থেকে ভেসে আসে ওরা তোমাদের ভাই। ওদেরকে শত্রু ভেবো না। আমরা ওদের কথা বলতে পারি না। অথচ ওরাই আমাদের ওপর সতত কাঁচা-পাকা মিথ্যা চাপিয়ে দেয়। আমরা ঠিক থেকেও বেঠিক হয়ে যাই। দেখুন! আমি এখনো ওদের পরিচয় বলতে পারছি না। আসলে আমাদের ভেতরে ভয় আছে। ভয়ের কার্যকরণও আছে...
এই দেখুন! কী শুরু করেছি। বলতে চেয়েছিলাম রাতের হাহাকারের কারণ, আর্তনাদের কারণ। কিন্তু শুরু করে দিলাম যাপিত জীবনের কাসুন্দি। থাক! আপনাদের বিরক্ত না করে বলেই ফেলি। আসলে আমাদের তল্লাটে একটা রোগী আছে। ওর পুরো দেহে অসুখ। কেবল ত্বকটা দিব্যি সুস্থ। এই ত্বকটা নিয়ে সেই রোগীটা জীবনের চারযুগ চার বছর পারি দিয়ে ফেলেছে। এই ত্বকের জোড়েই আমাদের এই তল্লাটে একটা মানচিত্র দখল করে রেখেছে এখনো। সেই রোগের কারণেই মানচিত্র দখল করতে হয়েছিল তার। দখল প্রক্রিয়ায় তার রক্তক্ষরণ হয়েছিল ঢের। আপনাদের না বললে বুঝবেন না! সেই রক্ত একটা সাগর ধারণ করতে পারবে না। অথচ রোগীটা নিজেই পুরোটা রক্ত দিয়েছিল। সেই রক্ত দিতে দিতেই তার ভেতরে আরেকটা রোগ বাসা বাঁধে। প্রাথমিকভাবে এই রোগটাকে কেউই তেমন পাত্তা দেয়নি। দিনে দিনে সেই রোগটা ঝেঁকে বসেছে তার ভেতরে। এখন তার ভাষা বদলে গেছে। তার আচরণ বদলে গেছে। আসলেই কি তার ভাষা ও আচরণ বদলে গেছে? ঠিক তা না। তার অবিভাজ্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা বদলে গেছে। তার ভেতরে ‘অসংখ্য’ হয়ে গেছে সে নিজেই।
এখন আমরা দেখতে পাই তার অসুখের কোন খবর নেই। নিজেকে নিয়ে এখন আর সে ভাবছে না। বরং আমারা দেখতে পাচ্ছি, সে তার নিয়ন্ত্রিত অঙ্গের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। নিজেকে এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। পারবেই কেমনে? সে নিজেই তো রুগ্ন। আসলে ক্রমশঃ নিজেকে আরো অসুস্থ করে তুলছে সে। আমরা তার কোন চিকিৎসা করতে পারছি না। আমরা তার ধারে কাছেই যেতে পারি না। যদিও তার খুব আপনজনকে কোন বিষয়ে পরামর্শ, উপদেশ অথবা অনুরোধ করতে যাই। তাহলে কত রকমের যে হেনস্তা হই। কখনো কখনো আমাদের বলা হয় তোমরা এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাও। তোমাদের মত এত সাধু-সন্ত আমরা হতে পারবো না। যদিও আমরা কেউই সাধু-সন্ত না। আমরা সবাই এই তল্লাটের।
আমরা সবাই মানবিক মানুষ। তবুও ওরা আমাদের সাধু-সন্ত বলে। কেন বলে? কারণও আছে। আমাদের এসব বললে, মানবিক মানুষ থেকে আমাদের দূরে রেখে আরেকটা প্রজাতি বানানো যায়। অতঃপর খুব দ্রুতই আমাদের বাক্সবন্দি করা যায়। ওরা বলুক। আমরা আমাদেরসহ ওদের আপন করতে চাই। আমাদের প্রতি ওদের মানবিক অনুভূতির উত্তরণ চাই। যদিও অতীতের ইতিহাস বলে, সেটা অসম্ভব। “আচ্ছা! আপনি কেন বার বার ‘ওরা’ ‘ওরা’ করছেন?” কেউ একজন আমাকে প্রশ্ন করে। আমি বুঝতে পারি না। আমি কেন ‘ওরা’ ‘ওরা’ করছি। ওরা কারা? এখানেই কেউ ওরা নেই। সবাই আমরা। মূলত, আমরা বলে এই তল্লাটের সবাই ‘আমরা’ হতে চাই। যাক ‘ওরা’ কেউ নেই। সবাই আমরা। আসুন আমরা আমাদের রোগীটা নিয়ে কথা বলি।
কিন্তু এতকিছুর পরও আমরা এই রোগীটাকে ভুলতে পারি না। এর প্রতি মমতা ত্যাগ করতে পারি না। মনে হয় এই রোগীটা একান্তই আমার। আমিই রোগী। এই রোগীর জীবনের সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে আছে। রোগীটার অবস্থার ক্রমশ অবনতি মানে আমারই অবস্থার অবনতি। আমরা কোথাও যেতে চাই না। আমাদের কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। যদিও অনেকেই আমাদের প্রানাধিক রোগীটার রোগ বাড়াতে চায় কেবল এই তল্লাটটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। কিন্তু আমরা কোথাও যাবো না। আমরা এই রোগীটাকে সুস্থ করতেই এই তল্লাটে থাকবো। একদিন না একদিন আমরা সুযোগ পাবোই এর চিকিৎসার। অবশ্য আমারা চিকিৎসার সুযোগ না পেলেও দুঃখ নেই। রোগিটা সুস্থ হলেই হলো।
“আপনি কী শুরু করলেন? সেই কখন বললেন, গভীর রাতের কথা। এখনো গভীর রাতের কাহিনী বলেননি। শুধু এদিক সেদিক কথা ঘুরাচ্ছেন!” আমি একটা অদৃশ্য ধমক স্পষ্ট শুনতে পাই। “দেখুন, কারো প্রিয় কেউ রোগী থাকলে তার মাথা কি ঠিক থাকে। আমার মাথাটা আসলেই আলোমেলো হয়ে গেছে।” বললাম আমি। “হুমম! আপনারা পারেনও। একজন আরেকজনরে দোষ দিয়ে দিব্বি রোগীটারে এড়িয়ে যাচ্ছেন। রোগীটার ভেতরে দগদগে ক্ষত এখন স্পষ্ট। অথচ আপনাদের দোষাদোষি এখনো থামলো না। রোগীটার জীবনটা অসংখ্য দুঃখের ফোল্ডারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠছে। তার ভেতরে হাজারো বিভাজিত ভাইরাসের আক্রমণ।
দেহের প্রতিটা অঙ্গ এখন একটা আরেকটার শত্রু হয়ে ওঠছে। অসংখ্য অগ্নিশিখা তার ভেতরটা পুড়ে ছাই করছে। আর আপনারা আছেন কে কাকে দোষী বানাতে পারবেন সেই ডার্টিগেমে। ছিঃ আপনারা এই অপরুপ তল্লাটের মালিক কীভাবে হলেন! সেটা আমার কখনই বুঝে আসে না।” অদৃশ্য আওয়াজটা বললো। কিন্তু আমাকে আর কোন কথা বলতে বারণ করলো। বললো, “তোমার মুখে প্রচ- দুর্গন্ধ। আমার সঙ্গে আর কতা বরবে না। যদি বেশি বকবক করো তাহলে তোমাকে বোবা বানিয়ে দেবো। তার আগে কেবল বল, রাতের কথা কী বলতে চেয়েছিলে?” আমি অনেক কিছু বলতে পারতাম। কিন্তু, কথায় জিতে যাওয়া আর বাস্তবে জিত থাকা এক নয়। তাই চুপ করলাম। বললাম রাতের কথা যথা সময়ে বলা হবে। অদৃশ্যে আর কোন আওয়াজ শুনতে পেলাম না।
০২.
যে রাগীটা নিয়ে আমি কথা বলছি। তার কোন চিকিৎসা হয়নি সেটা বলা যাবে না। আবার রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা হয়েছে সেটাও বলা যাবে না। অপরদিকে রোগীর ইচ্ছায় চিকিৎসার কোন সুযোগ যেহেতু নেই। সেজন্য রোগীও তার চিকিৎসক নির্বাচন করতে পারেনি কখনই। অথচ তার চিকিৎসা করতে বহুজন বহু পথে তার কাছে এসছে। বহু উপায়ে চিকিৎসা করতে চেয়েছে। কেউই সফল হতে পারেনি। কেউ কেউ সফলতার মুখ দেখেতে চেয়েইে রোগির ভাইরাসে নিজেই সংক্রমিত হয়ে নিঃশেষ হয়েছে। কেউ রোগীকে ওভার ডোজ দিয়ে রোগীর আঘাতে হারিয়ে গেছে কালের পাতায়। কিন্তু এই দুর্দান্ত ক্ষমতাধর ও লড়াইপটু রোগীটা নিজেকে কেবল ত্বকের সুস্থতা দিয়ে ঠিকিয়ে রেখেছে আমাদের এই তল্লাটে। এ এক আশ্চর্য ও দুর্দান্ত দুঃসাহসের গল্প। এই রোগীর বাস্তব জীবন নিয়ে সিনেমা হলে পৃথিবীর সব প্রেক্ষাগৃহে সুপার-ডুপার হিট হতো। কেবল তার মানচিত্র দখলের রক্তক্ষরণের কাহিনীই পৃথিবীকে নির্বাক করে দিয়েছিল।
এই পর্যন্ত তার চিকিৎসা করতে এসে দুজন ডাক্তার জীবন হারিয়েছেন। একজন ধুকে ধুকে বেঁচে আচেন। যিনি ধুকে ধুকে বেঁচে আছেন আর প্রতি এই রোগীর অভিশাপ আছে মনে হয়। তিনি এই রোগীকে বাঁচাতে অনেক অনেক তল্লাট ঘুরে সাহায্য এনছেন। কিন্তু এই সাহায্য রোগীর নানা অঙ্গ অচল করতে ব্যবহার করেছেন। অপর দিকে তিনি রোগীর চিকিৎসা না করে নিজের আর্দালি, কম্পাউন্ডার, আয়া, বুয়া, দেহরক্ষি, রক্ষিতাসহ নানা চাটুকারের পেছনে খরচ করতেন। ফলে রোগির অভিশাপে সেই ডাক্তার পতিত হয়েছেন পৃথিবীর সকল রোগীর কাছ থেকে। এখন আর তিনি চিকিৎসক নন। কেবল ভাড়ের অভিনয়ে বিনোদিত করতে চাচ্ছেন জগত সংসার। তবে, ‘অভাগা যে দিকে তাকায় সাগর শুকায়।’ তার ভাড়ামোতে এখন কেউ আর বিনোদন পায় না। পায় কেবল জীবানু আর জীবানু।
আরো দুজন ডাক্তার চিকিৎসা করছেন ঘুরেফিরে। রোগীর অবস্থার কোন বদল হয়নি। রোগী ক্রমাগত রোগের ভাইরাসে প্রবল হচ্ছে। সুস্থতায় না এগিয়ে রুগ্নতার দিকে এগুচ্ছে। ওফফ! আপনাদের বলাই হয়নি। এই রোগীর কিন্তু আরেকটা ক্ষমতা আছে। সে তার রোগের প্রভাবে প্রভাবশালী হতে পারে। এবং কখনো কখনো আমাদের তল্লাটের সবাইকে রুগ্ন করে দিতে পারে। প্রতিভাবান দু’জন ডাক্তারের চলমান চিকিৎসায় রোগী এখন নেতিবাচক ক্ষমতা অর্জন করছে। আমাদের তল্লাটের পুরো অবয়বকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। হিংস্রতার আগুন আর ফাঁপা চিৎকারের দুর্গন্ধ আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তোলছে। আমরা ক্রমশঃ রোগে ও রোগীতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। নতুন ডাক্তারে কোন খোঁজ নাই। সব নয়া ডাক্তার অতীতের ইতিহাসকে সামনে রেখে নিরাপদ অবস্থানে আত্মগোপন করছে। রোগীটা স্থবির হয়ে আছে। অথচ এমন ঘোর অমানিশার সময়ে ডাক্তারে ডাক্তারে শুরু হলো রায়ট! হতভাগা আমি এখন কোথাই যাই?
আবারো আমরা থেকে বেড়িয়ে আসতে হলো আমার। ‘ওরা’ নিয়ে কিছু বলতে হচ্ছে। আমরা যখন ঘোর অমানিশা দেখতে পাচ্ছি। রোগীর দেহের স্থবিরতা দেখতে পাচ্ছি। তারা তখন ব্যর্থ পুরোনো ডাক্তারকেই আবার চিকিৎসায় আনতে চাচ্ছে। অথবা গতবার ব্যর্থ ডাক্তারকেই তার ব্যর্থ সহযোগীসহ আনতে চাচ্ছে। যে সহযোগী নিজেকে নিখাঁদ বললেও তার ভেতেরে খাঁদের অভাব নেই। আমার সিক্সথ সেন্স দেখতে পারছে যে, রোগীর স্পিরিচুয়াল পাওয়ার বুঝে গেছে। তার জীবনে এখন গভীর রাতের অমানিশা। রোগী আমাদের ডাকছে। আমরা পারছি না, পুরনো ডাক্তারের দাপটে সামনে যেতে। রোগীর অভিশাপে আমরাও এখন পুড়ে যাচ্ছি। ক্ষমতা হারাচ্ছি অনুভবের। হয়ে যাচ্ছি লিলিপুট। ডাক্তারগুলোকে বানাচ্ছি গালিভার। আমাদের তল্লাটের প্রতিটা প্রতিবেশে ও শুন্যে ঝুলে আছে আমাদের জন্য ধিক্কার। আমরা এখন নিজেকে অপরাধি ভাবলেও একদল ‘ওরা’ ঠিকই চেহারায় চিকনাই ধরে রেখেছে অভিনব কুশলতায় অথবা নিপুন অভিনয়ে।
চলবে...