মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ আল-ফরিদী-
শিক্ষিত -অশিক্ষিত, ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবারই প্রত্যাশা সুখে-শান্তিতে বসবাস উপযোগী একটি সুন্দর সমাজ। যেখানে মানুষ নি:সংশয়ে নিরাপদে বসবাস করবে। জান-মাল,ইজ্জত-আব্রু নিয়ে যেখানে থাকবে না কোন শংকা। মুক্ত হাওয়ায় মুক্ত পরিবেশে কেটে যাবে জীবন। যেখানে কেউ কারো জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না কিংবা শান্তি ভঙ্গ করবে না কেউ কারো। আবাল-বৃদ্ধা বণিতা সবারই প্রত্যাশা এমন একটি সুন্দর সমাজ।কিন্তু এদেশের বাস্তব অবস্থার দিকে তাকালে চোখে ভেসে ওঠে হতাশার কালো মেঘ।মনে হয় এটা কোন মানুষের সমাজ নয়, শাপদ অরণ্যে বিচরণশীল দন্ত-নখর বিশিষ্ট কোন হিংস্র প্রাণীর সমাজ।যে সমাজে বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় পিতৃক্রোড়ে থাকা নিষ্পাপ শিশুর বুক,যে সমাজে ভাইয়ের সামনে বোন, মায়ের সামনে কন্যা, স্বামীর সামনে স্ত্রী হয় নির্মম ধর্ষণের শিকার, সেটাকে কি মানুষের সমাজ বলা যায়?
সুন্দর সমাজের প্রত্যাশা ও সমাজের বাস্তব অবস্থার মাঝে কিভাবে এত বিশাল ফরাক সৃষ্টি হলো সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। সুন্দর সমাজ পেতে হলে চাই ভাল মানুষ।কারণ অনেকগুলো মানুষের সমন্বয়েই একটি সমাজ গড়ে ওঠে। সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি ভাল হয়, তাহলে তাদের মাধ্যমে গঠিত সমাজ অবশ্যই সুন্দর হবে। দু:খের বিষয় যে, আমাদের দেশের কর্ণধারগণ এ পর্যন্ত ভাল মানুষ তৈরীর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উন্নতমানের দালান-কোঠা নির্মাণের জন্য উন্নতমানের ইঞ্জিনিয়ার তৈরীর ব্যবস্থা আছে, উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা লাভের জন্য ডাক্তার তৈরীর ব্যবস্থা আছে, উন্নতমানের ফসল ও ফলমুল উৎপাদনের জন্য উন্নতমানের কৃষি বিজ্ঞানী তৈরীর ব্যবস্থা আছে, এমনকি ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করার জন্য উন্নতমানের ক্যাডার বাহিনী তৈরীর ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু একটি সুষ্ঠু সুন্দর সভ্য সমাজের জন্য যে উন্নত চারিত্রিক গুণের অধিকারী ভাল মানুষের প্রয়োজন, সেই ভাল মানুষ তৈরীর কোন ব্যবস্থা নেই। বরং পারিবারিক ও অন্যান্য উপায়ে যারা নৈতিক মূল্যবোধ ও চারিত্রিক পবিত্রতা নিয়ে গড়ে ওঠে, তাদের সেই মূল্যবোধকেও সমূলে ধ্বংস করার জন্য নানাবিধ আয়োজন। যৌন সুড়সুড়িমূলক নভেল-নাটক, ডিস এন্টিনার দৌরাত্ম্য, নগ্ন ছায়াছবি, ব্লু-ফিল্ম ইত্যাদি জাতীয় চরিত্র সমূলে ধ্বংস করার "মহৎ" আয়োজন ছাড়া আর কি!
দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, এসব চরিত্র বিধ্বংসী কর্মকান্ড সরকারী অনুমোদন নিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হচ্ছে।এতো প্রতীয়মান হয় যে, এ দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ভাল মানুষ তৈরীর কোন সুযোগ নেই ; বরং অন্য উপায়ে যারা ভাল থাকদে চায়, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার কষাঘাতে তাদের অবস্থাও হুমকির সম্মুখীন। এহেন অবস্থায় সভ্য সুন্দর সমাজের প্রত্যাশা দুরাশার বৈ কি! নেপোলিয়ান বোনাপার্ট আক্ষেপ করে বলেছিলেন "আমাকে একজন আদর্শ মা এনে দাও, তাহলে আমি তোমাদেরকে ভাল জাতি উপহার দেব"।
তিনি শিক্ষিতা মায়ের কথা বলেননি। কারণ কেউ শিক্ষিত হলেই ভাল হয়ে যায় না। বিশেষত: যে শিক্ষায় সকল ভালর উৎস মূল আল্লাহ-রাসূল ও দ্বীন ধর্মকে অস্বীকার করা হয়,সে শিক্ষায় ভাল মানুষের আশা করা বৃথা। বর্তমান আমেরিকার ৭৯% নাগরিক তাদের পিতার নাম বলতে অক্ষম। যাদের নৈতিক অবস্থা এতটা শোচনীয়, সেই ইউরোপ আমেরিকার হাভার্ড, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের শিক্ষায় ভাল মানুষ তৈরী হবে কিরুপে! ভাল মানুষের সান্নিধ্য লাভ ছাড়া ভাল মানুষ হওয়া যায় না।
এ পৃথিবীতে সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর সান্নিধ্যে এসেই আরবের রক্ত-পিপাসু বর্বর জাতি মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠতম জাতিতে রুপান্তরিত হয়েছিলেন।হযরত আবু বকর,হযরত উমর রা. প্রমুখ মনীষীগণ নবীর সাজানো বাগানেরই একেকটি সুরভিত ফুল। যাদের ছোঁয়ায় পৃথিবী হয়েছে ধন্য। মানুষ পেয়েছে উন্নত ও মহোত্তম বাস্তব দৃষ্টান্ত। সুতরাং আমরা যদি ভাল মানুষের সন্ধান পেতে চাই, তাহলে আমাদেরকে নৈতিক আদর্শ বিবর্জিত পাশ্চাত্যের সেক্যুলার শিক্ষা পরিহার করে নববী আদর্শের পতাকাবাহী ইসলামী শিক্ষার শরণাপন্ন হতে হবে। তাহলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে নববী আদর্শে আদর্শবান সাহাবায়ে কেরামের মত উন্নত ও মহোত্তম মানুষ। যারা নববী আদর্শ বুকে ধারণ করে নিজেরা হয়েছেন পরিপূর্ণ এবং আপন সাহচর্যে অন্যদের গড়ে তুলেছেন শ্রেষ্ঠ মানুষ রুপে।
বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী,মুজাদ্দেদে আলফেসানী,শাহ আশরাফ আলী থানভী, হুসাইন আহমাদ মাদানী,মাওলানা ইলিয়াছ রহ. প্রমুখ মনীষীগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না, ছিলেন নববী আদর্শের মূর্তপ্রতীক একেকজন আধ্যাত্মিক সম্রাট। বহুপূর্বে তাঁরা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু যুগেযুগে রাষ্ট্রীয় শক্তি কর্তৃক মনুষ্যত্ব ও চরিত্র বিধ্বংসী কর্মকান্ডের মোকাবেলায় আদর্শ মানুষ গঠনের যে মহৎ কাজ তাঁরা করে গেছেন,সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাঁদোর যোগ্য উত্তরসূরীগণ জীবনবাজি রেখে সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন।এই সোনালী কাফেলার সংস্পর্শে এসেই পৃথিবীর মানুষ লাভ করেছে আলোকিত জীবনের সন্ধান।পেয়েছে মনুষ্যত্বের দীক্ষা।বস্তুবাদী সভ্যতার এই চরমোৎকর্ষের যুগেও যারা মহোত্তম জীবনের সন্ধান পেতে চায় ; তারা রঙ্গময় জীবনের সকল হাতছানিকে দুপায়ে দলে ছুটে আসে সেই সোনালী কাফেলার সংস্পর্শে।
এ দেশবাসীর সৌভাগ্য যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিস্তৃত হাজার হাজার কওমী মাদরাসা, মাওলানা ইলিয়াছ রহ. প্রতিষ্ঠিত তাবলীগ জামাত, হযরত থানভী রহ. প্রতিষ্ঠিত মসজিলে দাওয়াতুল হক শতবর্ষ ধরে বাতিল শক্তির সকল ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আদর্শ মানব গঠনে গৌরবময় ভূমিকা পালন করে চলছে। নানাবিধ অপরাধ কর্মে আকন্ঠ নিমজ্জিত এই সমাজে এখনো যে অপরাধমুক্ত, পূত:পবিত্র লক্ষ লক্ষ মানুষ বিরাজ করছে, তা এসব প্রতিষ্ঠানেরই গৌরবজ্জ্বল অবদান। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে ইতোমধ্যে তাবলীগী ইজতেমা সম্পন্ন হয়েছে। মজলিসে দাওয়াতুল হকের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৯ মার্চ। দেশের প্রতিটি জেলা থেকে হাজার হাজার উলামা-মাশায়েখ ও দ্বীনদার মুসলমানগণ এতে অংশগ্রহন করবেন। দিন ব্যাপী এ ইজতেমার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে "জীবনের সকল কর্মকান্ডকে নবীর আদর্শে ঢেলে সাজাবার দীক্ষা গ্রহণ করি"।
আরও পড়ুন : ৯ মার্চ যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় দাওয়াতুল হকের ইজতেমা