আবদুল্লাহ আল ফারুক
সপ্তম ঈসায়ি শতাব্দীতে মহান আল্লাহ সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেন। তখন ছিল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম যুগ। পুরো মানবতা তখন আত্মহননের পথে হাঁটছিল। মানুষ ভুলে গিয়েছিল নিজ ¯স্রষ্টা ও অধিপতির পরিচয়। আত্মপরিচয় হারানোর পাশাপাশি ভুলে গিয়েছিল নিজের পরিণতির কথাও। তার মাঝে ভালো-মন্দের বাছবিচার করার ন্যূনতম যোগ্যতাও ছিল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, সবার মন-মস্তিষ্কে বড় ধরনের পচন ধরেছে। ধর্ম ও পরকালের দিকে মাথা তুলে তাকানোর ফুরসতটুকুও কারও ছিল না। প্রাণ ও আত্মার খোরাক, পরকালীন কল্যাণ, মানবতার সেবা ও চরিত্রসংশোধনের জন্য তাদের কাছে এক মুহূর্তের অবসরও ছিল না। আপনি হয়তো আশ্চর্য হবেন, ইতিহাসের সেই কালো সময়কালের সঙ্গে আমাদের বর্তমান সময়ের দুঃখজনক সাদৃশ্য রয়েছে।
এই বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা দূর করা ও মানবপ্রজন্মকে বিভ্রান্তির গহ্বর থেকে বের করে হিদায়াতের পথে তুলে আনার জন্য ঈসায়ি সপ্তম শতাব্দীর দশম বছর বিশ্ববাসীর গর্ব, সৃষ্টিকুল-সর্দার হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা নবুওয়াতের দীপ্ত আলোকবর্তিকা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।
এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, আমাদের মাঝে প্রচুর দুর্বলতা রয়েছে। আমাদের ভুল-ত্রুটির সীমা-পরিসীমা নেই। কিন্তু এরপরও মহান আল্লাহ আমাদের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তা হলো, তিনি আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে শ্রেষ্ঠ আদমসন্তান, দোজাহানের সর্দার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিপুল-নিঃসীম ভালোবাসা দান করেছেন। প্রত্যেক মুমিনের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান, এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয়। এই ভালোবাসাই মুমিনের সত্যিকারের পরিচয়।
রাসূলের প্রতি ভালোবাসা লালন না করে কোনো মুসলিম মুসলিম থাকে না। বিস্ময়ের বিষয় হলো, এই তীব্র ভালোবাসা সত্ত্বেও পৃথিবীর যে ব্যক্তিই নবিজির সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব, গুণাবলি ও মাহাত্ম্য, জীবনচরিত ও কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে বয়ান করার চেষ্টা করেছে, তাকে অক্ষমতার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়েছে যে, ‘আমি নবিজীবনের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরতে পারিনি।’ পৃথিবীর যেকোনো পাঠক ও যেকোনো শ্রোতা এ ধরনের স্বীকারোক্তি প্রদান করতে বাধ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী যতবার পঠিত হোক, যতবার আলোচিত হোক, তৃষ্ণা মিটবে না। প্রতিবার নতুন নতুন স্বাদ আর নতুন নতুন আলো ভেসে ওঠে। এটাই তো সেই সঞ্জীবনী সুধা, যার ছোঁয়া পেয়ে এক মুঠো মাটিও অমরত্ব পেয়ে, চিরস্থায়ী নিআমতের ভাস্বর হয়ে ওঠে।
আজকের এই অগ্নিতপ্ত পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহর সম্মুখে অজস্র চ্যালেঞ্জ ফনা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কুফরি শক্তি পূর্ণ চাতুর্য, পূর্ণ শক্তি ব্যয় করে অবলীলায় ইসলাম ধ্বংস করার মিশনে লিপ্ত রয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় খায়েশ হলো, যেকোনো মূল্যে মুসলিমদের অন্তর থেকে আল্লাহ তাআলার চিরন্তন বার্তাবাহক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে হবে। তারা দুনিয়ার চাকচিক্য, বস্তুবাদী জীবনের ভোগ-বিলাস-ব্যঞ্জন, অবাধ্য যৌনক্ষুধা পূরণের অজস্র ক্ষেত্র সরবরাহ করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আধ্যাত্মিক স্বাদ ও শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বদ্ধপরিকর।
তারা চাচ্ছে, যেকোনো মূল্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রহমতের আঁচল থেকে মুসলিমসমাজকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। তারা চাচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা ও আদর্শের মূল আত্মা বিকৃত করে ফেলতে। আমরা মনে করি, তাগুতি শক্তির এ সকল কৌশল নিষ্ক্রিয় করে ফেলার মোক্ষম হাতিয়ার একটাই। তা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা ও আনুগত্যের সঙ্গে আমাদের বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে তুলতে হবে। প্রতিটি অন্তরে ভালোবাসার পিদিমের আলো আরও উজ্জ্বল করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্ক হতে হবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতের বাতিঘর।
ইতিহাসের সেই দায় ও সময়ের সেই চাহিদা থেকেই রচিত হয়েছে এই অনন্য অসাধারণ সুবিশাল ‘সীরাত বিশ্বকোষ।’ এই সীরাত বিশ্বকোষের মাঝে সাইয়্যেদুনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত পূর্ণ জীবনের সমস্ত বিবরণ ও ঘটনাপ্রবাহ আনুষঙ্গিক ছোট-খাটো বিষয়াবলি সহকারে সামগ্রিক তথ্যসমৃদ্ধ আকারে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইসলামের আহ্বান ধ্বনিত হওয়ার পূর্বে আরব উপদ্বীপের অধিবাসী, তাদের জীবনচিত্র, সামাজিক আচরণ, অর্থাৎ যাবতীয় বৈশিষ্ট্যাবলি ছাড়াও আশপাশের সবগুলো জাতি ও সম্প্রদায়ের বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো, যেন মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্ব ও সর্বাধিক আলোকোজ্জ্বল যুগের সূচনালগ্নের প্রেক্ষাপট পাঠকবর্গের দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে। সবাই যেন মহান আল্লাহর এই গভীর প্রজ্ঞাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বুঝতে সক্ষম হন যে, আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌভাগ্যময় জন্ম ও প্রেরণের জন্য কী কারণে আরব উপদ্বীপকেই বিশেষভাবে নির্বাচন করলেন।
বিশাল এই সীরাতবিশ্বকোষ মূলত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রকাশনাপ্রতিষ্ঠান দারুস সালামের উদ্যোগে গবেষক, স্কলার ও উলামায়ে কেরামের একটি সমন্বিত বোর্ড রচনা করেছে। বাংলাদেশের অন্যতম সর্ববৃহৎ ইসলামি প্রকাশনী মাকতাবাতুল আযহার একটি চৌকষ অনুবাদটিমের সহায়তায়, দক্ষ সম্পাদকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে বইটির সহজ-সরল বাংলা অনুবাদের গুরুদায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছে।
সীরাত বিশ্বকোষ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনার এই অতীব গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান সময়ের একদল প্রতিশ্রুতিশীল যোগ্য, পড়–য়া ও বিজ্ঞ লেখকম-লী। তাঁরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছেন যে, মহামানবের জীবনের জ্ঞানতাত্ত্বিক, চৈন্তিক বৈশিষ্ট্যগুলো ও তাঁর কর্মময় জীবনের সবগুলো প্রান্ত পাঠকের সামনে নিখুঁতাকারে ফুটিয়ে তুলতে। তাঁরা প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন, এই অসাধারণ গ্রন্থটি যেন বর্ণনাশৈলী ও প্রভাব বিস্তারের বিচারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনের বিভিন্ন স্তর, ঘটনাপ্রবাহ ও তথ্যচিত্রগুলোকে বিশেষ আবেগ ও সংবাদ বুকে নিয়ে পাঠকের দোরগোড়ায় হাজির হতে পারে। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই সীরাত বিশ্বকোষের মাঝে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনবৃত্তান্ত তারিখ ও সময়ক্রম মেনে সংকলন করা হয়েছে।
আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করছি যে, হে বিশ্বপ্রতিপালক, আপনি আমাদের মানবতার মহান পথপ্রদর্শক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি ঘটনা এমনভাবে পড়ার, দেখার ও বোঝার তাওফিক দিন, যেন আমরা প্রিয় নবিজির যুগে বসবাস করছি। মহান আল্লাহ সীরাত বিশ্বকোষের সব পাঠকদের চৈন্তিক ও মানসিকভাবে সেই পবিত্র পরিবেশে পৌঁছে দিন, যেখানে মানবশ্রেষ্ঠ, রাসূলগৌরব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবেতিহাসের সবচেয়ে সফল কাফেলা সাহাবায়ে কেরাম রাদি.-কে আল্লাহর বন্দেগি ও জীবনের শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছিলেন।
সীরাত বিশ্বকোষ
খ-সংখ্যা : ১১
পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৬৬৫৬
[৮০ গ্রাম কালার অফসেট কাগজ]প্রকাশনা
মাকতাবাতুল আযহার, মধ্যবাড্ডা, ঢাকা
০১৯২৪০৭৬৩৬৫