পলাশ রহমান
বাংলাদেশের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির মধ্যে সব চেয়ে বেশি নির্যাতনের মুখে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্র সংগঠন শিবির। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বর্ষিয়ান প্রায় সব নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। শিবিরের নেতৃত্ব দেয়া হাজার হাজার নেতাকর্মীকে পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছে। গুম করা হয়েছে। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। বিনা বিচারে জেলখানায় আটকে রাখা হয়েছে। জামায়াতের নির্বাচনী নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বোঝা যায় সরকার বাংলাদেশ থেকে জামায়াত শিবির মুছে ফেলতে চায়। জামায়াতের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে চায়। তাদের নেতৃত্বশূন্য করতে চায়।
এতে সরকারের অনেক লাভ। প্রথম লাভ হলো দেশের ইসলামপন্থীদের দমন করা। কারন সরকারী রাজনীতিকরা মনে করেন, ধর্ম এবং রাষ্ট্র ভিন্ন দুটি বিষয়। একটির সাথে অন্যটি মেলানো যাবে না। ধর্ম থাকবে মসজিদ, মন্দিরে। রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায়, শিক্ষায় ধর্মের কোনো প্রভাব থাকবে না। অর্থাৎ তারা ‘ইসলাম’ মানেন বা পালন করেন ‘ধর্ম’ হিসাবে, আদর্শ হিসাবে নয়। ইসলামকে তারা আদর্শ হিসাবে বরদাস্ত করতে রাজি নন। কিন্তু দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতিকরা ‘ইসলাম’ কে শুধুমাত্র ধর্ম নয়, আদর্শ হিসাবে মানতে চায়। রাষ্ট্রে ইসলামি আদর্শের শাসন কায়েম করতে চায়। এখানেই সরকারের সাথে ইসলাপন্থীদের মূল বিরোধ। তাছাড়া সরকারী দল রাজনীতির সরলাঙ্ক মিলিয়ে দেখেছে, বাংলাদেশে বিএনপি জামায়াতের রাজনৈতিক বা নির্বাচনী ঐক্য অব্যাহত থাকলে ক্ষমতার মুখ দেখা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন- রোহিঙ্গা : বিষয়টা হেলাফেলার পর্যায়ে নেই
এ হিসাব মিলাতে বেশি দুরে যাওয়ার দরকার নেই, একানব্বই থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে কটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর ফলাফল এবং জোটের দিকে নজর দিলেই পরিস্কার বোঝা যায়। জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা দলীয় ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। তাদের কারনেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দাড়ি-টুপি দেখলেই বলে রাজাকার, আলবদর। দেশ স্বাধীনের পরেও তারা তাদের ভুল সুধরে নেয়নি। তারা যে সংগঠন নিয়ে স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল সেই সংগঠন নিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে। তাদের যে নেতারা স্বাধীনতার বিরোধীতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদেরকেই স্বাধীন দেশে নেতৃত্বে রাখে।
এই ভুলের মাশুল এখন তারা গুনছে। তাদের ভুল রাজনীতি, অহংকার এবং নেতৃত্বের লোভের কারনেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখনো ইসলামি দলকে, ইসলামের রাজনীতিকে বাকা চোখে দেখে। তাদের ভুলের কারনে দেশে হাজার হাজার ইসলামপ্রেমি যুবকের জীবন আজ বিপন্ন। তাদের সামনে কোনো আলো নেই, উজ্জল ভবিষ্যত নেই। জামায়াত শিবিরের অনেকেই হয়তো মন খারাপ করবে, কিন্তু এটাই কঠিন সত্যি- জামায়াতের ভুল রাজনীতির কারনেই ইসলামি রাজনীতির জন্য বাংলাদেশের সমতল ভূমি সবচেয়ে বেশি বন্ধুর হয়েছে।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, জামায়াত না থাকলে বা স্বাধীনতা বিরোধী নেতারা নেতৃত্বে না থাকলে কি দেশের ইসলামপন্থীরা নির্যাতনের মুখে পড়তো না? বিরোধীতার মুখে পড়তো না? হয়তো পড়তো, কিন্তু নির্যাতকরা এতটা জনসমর্থন পেতো না। সরকারী নির্যাতনে পড়লে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে আনুকুল্য পেতো। সহানুভুতি পেতো। এতটা অসহায় হতো না। আজ এত বছর পরে, এত বিসর্জনের পরে ব্যারিষ্টার রাজ্জাক বা শিবির নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুরা যা বুঝেছেন, ঢাবির শিবির নেতা আবদুল কাদের বাচ্চুরা তা বুঝেছিলেন অনেক আগে।
আরও পড়ুন- কাদিয়ানিদের ব্যাপারে সামাধানে আসুন
১৯৮৪ সালে প্রায় অভিন্ন দাবি তুলে তারা শিবির থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। তারা জামায়াতের স্বাধীনতা বিরোধী নেতাদের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, আপনারা নেতৃত্বে থাকলে এক সময় কঠিন মাশুল গুনতে হবে। জামায়াতের সে সময়ের নেতারা আবদুল কাদের বাচ্চুদের কথা কানে না তুলে প্রায় দুই শতাধিক শিবির নেতাকে দল থেকে বহিস্কার করেছিলেন।
পরে তারা যুব শিবির নামে আলাদা সংগঠন করেছিলেন, কিন্তু জামায়াতের অসহযোগিতায় বেশি দুর এগুতে পারেননি। জামায়াতের ক্ষমতা লোভী নেতারা সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভুমিকার দায় নতুন প্রজন্ম নিতে চায় না। যুব সংগঠন করার সুযোগ দিলে নতুন করে ওই বিষয় আবার সামনে চলে আসতে পারে। এতে তাদের নেতৃত্বে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাদের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। যা তারা কোনো দিনই চাননি। ফলে এখন পর্যন্ত জামায়াতের কোনো যুব সংগঠন নেই। আর এভাবেই মাশুল গুনতে হয়েছে, হচ্ছে জামায়াত কে।
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতি। বাংলাদেশে জামায়াতের কোনো বন্ধু নেই। থাকবে কি করে? তারা সমমতের মানুষদের বাদ দিয়ে, সমআদর্শের দল বাদ দিয়ে ঐক্য করেছে বিএনপি-আওয়ামীলীগের সাথে। দেশের অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সাথে তাদের সুসম্পর্ক নেই। ঐক্য নেই, জোট নেই। চরম দুসময়ে বিএনপি কতোটা দাঁড়িয়েছে তাদের পাশে? কতোটা, কি ভুমিকা রেখেছে? ঘোড়ার সাথে ঘোড়ার পালের বন্ধুত্ব হয়, শিংহর সাথে শিংহ পালের। নিজের গোত্র ছাড়ে অন্য গোত্রে কেউ বেশি দিন টিকতে পারে না। স্বার্থের জন্য সাময়িক বন্ধুত্ব হতে পারে, স্থায়ী হয় না। বিপদের সময়ে পাশে পাওয়া যায় না।
এ হিসাব তো পাগলেও বোঝে, জামায়াত কেনো বুঝলো না? জামায়াত বিএনপির সাথে ঐক্য করে, আওয়ামীলীগের সাথে ঐক্য করে, কিন্তু দেশের ইসলামপন্থীদের সাথে করে না। সচেতন ভাবে বিরোধ জিয়িয়ে রাখে। দুরত্ব বজায়ে রাখে। কারন কি? কারন একটাই, অহংকার। তারা অন্যদের গোনায় ধরে না। এখানেই জামায়াতের রাজনীতির অন্যতম বড় ভুল। জামায়াতের বর্তমান নেতারা যদি এই বাস্তবতা বুঝতে পারেন, বোঝার চেষ্টা করেন, ভালো। নয়তো একাত্তরের পাপের মতো হাজার হাজার ইসলামপ্রেমী তরুণ যুবকের জীবন বিপন্ন করার জন্যও একদিন তাদের চড়া মাশুল গুনতে হবে।