সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বসেছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯। গ্রন্থমেলা মানেই তো জ্ঞানের মেলা। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। প্রাণের স্পন্দন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দীপ্ত প্রাণের স্পন্দন। সেইসঙ্গে তারুণ্যের মেলা। তাই মেলা ভীষণভাবে কাছে টানে। গ্রন্থমেলায় আসলে পাঠক অন্যরকম মুগ্ধ হয়। এর কোলাহল পাঠককে আনন্দ দেয়। মেলা মানেই সম্ভাবনা। মেলা মানেই বাঙালি সংস্কৃতির স্ফুরণ।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রসঙ্গে পাবলিক ভয়েসের সহ-সম্পাদক নাজমুল ইসলাম কাসিমীর সাথে বই প্রকাশ, গ্রন্থমেলায় স্টল না-পাওয়া, বইয়ের মূল্য, নবীন লেখকদের প্রতি দিকনির্দেশনা, গ্রন্থমেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন কালান্তর প্রকাশনীর সিইও লেখক ও সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ।
নাজমুল : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।
আবুল কালাম আজাদ : ওয়া আলাইকুম সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
নাজমুল : কেমন আছেন?
আবুল কালাম আজাদ : আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
নাজমুল : আসন্ন একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা ও মতামত জানতে চাচ্ছিলাম। বইমেলা নিয়ে সার্বিকভাবে যদি কোনো মূল্যায়ন করতে বলি তাহলে কীভাবে দেখেন এই পুরো বিষয়টিকে?
আবুল কালাম আজাদ : বইমেলা নিয়ে মূল্যায়ন করা আমার মতো মানুষের জন্য কঠিন। কিন্তু আপনি প্রশ্ন করেছেন বিধায় বলছি। এরকম একটি জাতীয় মেলা অবশ্যই দরকার। যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। এরকম মেলা লেখক-পাঠক বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখে।
বাংলা একাডেমিসহ মেলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং আমাদের দেশের তাবৎ মিডিয়া এই বইমেলাকে সামনে রেখে যেহেতু মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা আর কলমের স্বাধীনতার কথা বলেন; তখন অনিবার্যভাবে প্রশ্ন আসে যে, তাহলে কেন সেখানে ইসলামি ঘরানার লাইব্রেরি স্টল পায় না। যেখানে ৫৫% লোকের ভাষা বাংলা হওয়ার কারণে যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার দাবি আসে, তাহলে ৯০% লোক মুসলমান হওয়ার পর কেন ইসলামকে দূরে টেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে?
আপনি যদি বইয়ের কাটতি বা কোয়ালিটির দিক বিবেচনায় নেন, তাহলে সাধারণ ঘরানার প্রকাশনীগুলো ইসলামি প্রকাশনীগুলোর ধারেকাছেও আসতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
আর আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এটি কোনো গোষ্ঠী বা মতবাদের বইমেলা নয়; এটি জাতীয় বইমেলা। জনগণের টাকায়ই সরকার মেলার আয়োজন করে। তাহলে কেন সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে না। ন্যূনতম ছাড় দেওয়া হবে না? আর আমরা যারা মেলার বিরোধিতা করি, তারা কোন যুক্তিতে করি সেটা বোধগম্য নয়। এভাবে নিজে নিজে সবকিছু থেকে সরে আসলে তো সে দায়ভার অন্যের নয়।
নাজমুল : আপনি নিজেও একটি প্রকাশনীর সাথে সম্পৃক্ত। আপনাদের প্রকাশনী থেকে এবার কী কী বই আমরা পাচ্ছি। সংক্ষেপে যদি বলেন পাঠকরা সেই বইগুলো কেন সংগ্রহ করবে?
আবুল কালাম আজাদ : আমাদের কালান্তর প্রকাশনী থেকে এবারের বইমেলাকে কেন্দ্র করে ১৫টি বই প্রকাশের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু বইমেলায় স্টল না-পাওয়ায় সবগুলো বই প্রকাশ হবে না। তবে ইতোমধ্যে চারটি বই প্রকাশ পেয়েছে। ড. আলি সাল্লাবির ‘খারেজি’, ইমাম আবু বকর বাগদাদির ‘উলামাচরিত’, কথাসাহিত্যিক রশীদ জামীলের দুটি উপন্যাস ‘সুখের মতো কান্না’ এবং ‘একটি স্বপ্নভেজা সন্ধ্যা’।
আগামী সপ্তাহে আসবে ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবির ‘লায়ন অব দ্য ডেজার্ট উমর মুখতার এবং আবু লুবাবা শাহ মানসুরের ‘স্পেন টু আমেরিকা’। ২১ ফেব্রুয়ারি নাজমুল ইসলাম কাসিমীর ‘বিস্ময়বালক’ নামে একটি গ্রন্থও আসবে ইনশাআল্লাহ। এই বইটি নিয়ে আমরা অনেক আশাবাদী। পাকিস্তানের বিস্ময়বালক আর ক্ষুদে প্রফেসর হিসেবে খ্যাত হাম্মাদ সাফিকে নিয়ে রচিত এই বইটি।
আমরা চেষ্টা করি একটু ব্যতিক্রমধর্শী কাজ করার। যে বিষয়ে বই করছি, সাধারণত এসব বিষয়ের বই বাংলাভাষায় তেমন একটা নেই। যা-ও আছে অধিকাংশের মান প্রশ্নবিদ্ধ। ইতিহাস বলেন আর গবেষণা, বা অন্য কিছু।
নাজমুল : বইমেলায় ইসলামি প্রকাশনীগুলোর স্টল রাখা না-রাখা সংক্রান্ত নানা জটিলতার কথা আমরা শুনি..। এ বিষয়ে আপনি যদি কিছু বলতেন?
আবুল কালাম আজাদ : বইমেলায় স্টল না-থাকা নিয়ে আমার মনে হয় একাডেমি কর্তৃপক্ষ যতটা উদাসীন, তারচে কোনো অংশে কম উদাসীন নয় ইসলামি ঘরানার প্রকাশনীগুলো। কারণ, একাডেমি তার একটা নীতিমালা করেছে, আমরা অধিকাংশই মনে হয় সেসব নীতিমালা ফলো করি না বা করতে চাই না। মনে করুন আইএসবিএন ব্যবহার, ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন সার্টিফিকেট, নির্দিষ্ট সংখ্যক বই প্রকাশ করা, বইয়ের কোয়ালিটি মেন্টেইন করা ইত্যাদি। শুধু ধর্মীয় বই প্রকাশ না করে অন্যান্য সাধারণ বিষয় নিয়েও কিছু বই প্রকাশ করা।
নাজমুল : তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন বইমেলায় স্টল না-পাওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রকাশনীগুলোরও দায় আছে।
আবুল কালাম আজাদ : কিছুটা দায় তো অবশ্যই আছে। ওই যে বললাম, বাংলা একাডেমির নীতিমালার প্রতি খেয়াল না করা, জেনারেল লাইনের বই-পুস্তক প্রকাশে কিছুটা অনিহা... এগুলোও একটা কারণ। তবে আমাদের ত্রুটিবিচ্যুতি কিছুটা থাকলেও সাধারণ ঘরানার প্রকাশনী বা বই থেকে আমরা কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই। তো এসব বিষয় মেন্টেইন করার পরও অনেকে স্টল যখন পায় না, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে ‘বাংলা একাডেমি তুমি কার?’
নাজমুল : বইয়ের মূল্য এবং মানসম্মত বই পাওয়া নিয়ে পাঠকদের অনেক অভিযোগ? বিশেষত ইসলামি প্রকাশনীগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় এ ধরণের কথা শোনা যায়? কীভাবে দেখেন বিষয়টিকে?
আবুল কালাম আজাদ : এই পাঠক বলতে আসলে কারা সেটা বুঝতে পারছি না। তারা যদি তিরটা ইসলামি ঘরানার দিকে তাক করেন, তাহলে বলব তারা ইসলামি বই পড়া তো দূরের কথা একবার হাতে নিয়েও দেখেননি। তবে হ্যাঁ, আমাদের প্রাচীন কিছু প্রকাশনী এখনও বইয়ের প্রচ্ছদ, বাঁধাই, কাগজ ইত্যাদি দৃষ্টিনন্দন করছেন না, উন্নত করছেন না। তবে এরকম কিছু প্রকাশনী থাকাও উচিত মনে করি। আর দামের ক্ষেত্রে বলতে গেলে আমি বলব, ইসলামি ঘরানার বই যে দামে বিক্রি হয়, এটাকে মূল্য না বলে ফ্রি বলাই বেটার। ১৫০ পেইজের একটা বই তারা ৩০০ টাকা বিক্রি করে। আমাদের প্রকাশনীগুলো ৮০-১০০ টাকায় সেটা বিক্রি করে। কোনো কোনো প্রকাশনীকে আরও কম দামে বিক্রি করতে দেখা যায়।
নাজমুল : একই বই বারবার অনুবাদ করা নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। তারচেয়ে কি যেসকল বই এখনো অনুবাদ হয়নি সেগুলোর ক্ষেত্রে মনোযোগ দেওয়াই বেশি ভালো নয়?
আবুল কালাম আজাদ : একই বই একাধিক প্রকাশনী থেকে বের হওয়া দূষণীয় কিছু নয়; বরং এমনটা হওয়া উচিত। কেন উচিত, সেটা বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে। তবে একটা কথা বলি, কে কোন বই অনুবাদ করছে, কোন প্রকাশনী কার বই প্রকাশ করছে; এটা জানা খুবই দুঃসাধ্য একটা কাজ। দেখা যায়, একই সময় দুটি প্রকাশনী একই বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করছে।
কিন্তু কেউ কারও বিষয় জানে না। তাহলে এটা আপনি বন্ধ করবেন কীভাবে? আর হ্যাঁ, যাদের বই বা যেসব বই অনুবাদ হওয়া দরকার; কিন্তু হচ্ছে না; সেগুলো অবশ্যই অনুবাদে এগিয়ে আসা দরকার।
নাজমুল : নতুন লেখকদের উদ্দেশ্যে করে কিছু বলার আছে? আর নতুনদের জন্য আপনারা কতটা সুযোগ করে দিচ্ছেন?
আবুল কালাম আজাদ : লেখালেখি করতে হলে অধ্যয়ন করতে হবে। এক পৃষ্ঠা লিখতে ২০ পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করা উচিত। অধ্যয়নের বিকল্প নেই। সাদা কাগজ কালো কালিতে রাঙিয়ে দিলেই লেখা হয় না। এক্ষেত্রে অবশ্যই ভাষা, বানান, শব্দপ্রয়োগে যত্নবান হওয়াও দরকার। মনে রাখা দরকার যে, সেকেলে বানান আপনার লেখার মান অনেকটা কমিয়ে দিতে পারে। আর ভুল বানানের বই পড়া উচিত মনে করি না আমি।
দ্বিতীয় যে কথাটি বলব, চরম ধৈর্যের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। একটি বই লেখার পর তা প্রকাশনীতে জমা দিলেই যে প্রকাশ হয়ে যাবে; এমনটা ভেবে বসা অনুচিত। একটি বই প্রকাশের পিছনে যে কর্মযজ্ঞ হয়, অনেকেই দেখেন না বা দেখার সুযোগ পান না। তারা জানেনও না যে, কতজন লোক কতটা সময় ব্যয় করেন একটি বই প্রকাশের ক্ষেত্রে।
নবীন লেখকদের জন্য আমরা উদার। আমাদের প্রকাশনীতে এ পর্যন্ত যাদের বই বেরিয়েছে; তাদের অধিকাংশই নবীন। নবীনদের জায়গা না দিলে তারা প্রবীণ হবে কীভাবে? তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে, কয়েকজন প্রবীণের সাথে মিট করা যতটুকু সহজ একজন নবীনকে টেনে নেওয়া তার থেকে কঠিন।
নাজমুল : ইদানীং ফেইসবুকের কল্যাণে নতুন অনেক লেখক বেরিয়ে আসছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ ভালোই লিখছেন। কিন্তু কারও কারও মাঝে এখনই 'বিরাট কিছু হয়ে গেছি'- এমন একটা ভাব দেখা যায়। মানে তাদেরকে অন্যরকম ভাব নিতে দেখা যায়। ব্যাপারটিকে আপনি তাদের জন্য কীভাবে দেখতে চাইবেন?
আবুল কালাম আজাদ : ব্যাপারটি আমিও লক্ষ করে থাকি। আর একজন লেখকের জন্য ব্যাপারটি খুবই ডেঞ্জারাস। তার লেখক সত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য এমন মেন্টালিটিই যথেষ্ট। তবে এটা তাদের বয়সজনিত অপরিপক্ষতার কারণেই হয়ে থাকে। আমার বিশ্বাস সময়ের সাথে সাথে তাদের কথা ও আচরণে পরিপক্ষতা চলে আসবে।