নুর মাহাম্মদ
বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলায় ইসলামি প্রকাশনীগুলোকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এইটা নিয়ে ইসলামপন্থী ভাইদের মাতম দেখছি। অনেক প্রকাশক ভাই এইটা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছে, অনেক পাঠক তো বটেই! আমাকে অনেকে অনুরোধ করেছেন, এই বেইনসাফি নিয়ে যেন আমিও প্রতিবাদে শামিল হই।
একজন পাবলিশার হিসেবে আমি আমার অবস্থান পরিস্কার করছি।
বাংলা একাডেমির এই সিদ্ধান্তের আমি কোনো প্রতিবাদ করছি না। মানে প্রতিবাদ করার মতো নৈতিক শক্তি অন্তত আমার নেই। আমি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে এই ইস্যুতে ধন্যবাদ দিতে না পারলেও সমালোচনা করছি না। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, বাংলা একাডেমি ইসলামি প্রকাশনীগুলোকে স্টল বরাদ্দ না দিয়ে খুব বেশি অন্যায় করেনি, জুলুম করেনি। অনেকাংশে উচিত কাজটাই করেছে।
ইতোমধ্যে অনেকেই আঁতকে উঠেছেন, তাই না?
আচ্ছা, বাদ দিন একুশে বইমেলার কথা। সেক্যুলার সমাজ তো বলেকয়ে ইসলামপন্থীদের বর্জন করে, ঘৃণা করে, উপেক্ষা করে।
চলুন, দেশের ইসলামপন্থী মানুষদের একটু পড়ে আসি।
আপনারা জানেন, বাংলাদেশে ইসলামি সাহিত্য তৈরি, বিক্রি, প্রচার, প্রসার গত দুবছরে জ্যামিতিকহারে বেড়েছে। সত্যিই এটা বড়ো তৃপ্তির! তো, ইসলামপন্থী পাবলিশাররা একদিন বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল দেশব্যাপী 'কিতাবমেলা' করা হবে; যেখানে সকল ইসলামপন্থী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করবে।
যেই কথা সেই কাজ। শুরু হলো কিতাবমেলা। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান উদার হৃদয়ে সকল ইসলামপন্থী প্রকাশনীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করল। সকল মত ও চিন্তাধারার প্রকাশনী এক মোহনায় এসে মিলিত হলো। বিভিন্ন জায়গায় কিতাবমেলায় ব্যাপক রেসপন্স পাওয়া শুরু হলো। আমরা এক দারুণ সম্ভাবনা খুঁজে পেলাম। আমরা বাংলাদেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে বই ফেরি করে বেড়াচ্ছিলাম একসাথে; কিতাবমেলায়। নানান মত-চিন্তার মানুষ কিতাবমেলায় আসতে শুরু করল। আমরা বলাবলি করছিলাম, বাংলা একাডেমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমাদের জন্য দরজা বন্ধ করে পুরো বাংলাদেশের দরজা খুলে দিয়েছে।
বেশ চলছিল!
কিন্তু... কিন্তু... কিন্তু...
এক শহরের আয়োজক মাদরাসা কর্তৃপক্ষ কিতাবমেলার উদ্যোক্তাদের কাছে কয়েকটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। কারণ, সেসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের চিন্তাধারার নয়। নামের আগে মাকতাবা নেই, তাদের লম্বা দাড়ি নেই, পাঞ্জাবি পরে না, পাগড়ি পরে না, দেওবন্দ ধারায় তারা পড়াশোনা করেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরা ছোকরা ছেলে, মডারেট মুসলিম.... আরও বেশকিছু অভিযোগ।
বলাবাহুল্য সেই নিষেধাজ্ঞা পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আমার কর্মস্থলের প্রতিষ্ঠানও ছিল। কিতাবমেলার উদ্যোক্তারা আমাদের এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানাতে সত্যিই বিব্রতবোধ করছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ অন্তত উদ্যোক্তাদের নিয়তের পরিশুদ্ধতা দেখেছি, ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে নিয়ে পথ চলার উদারতা দেখেছি। উদ্যোক্তাদের প্রতি আমার ভালো ধারণা ও সম্পর্ক এখনও আগের মতোই অব্যাহত আছে। আমরা এখনও একসাথে বসে গল্প করি, পরিকল্পনা করি।
কিন্তু, ইসলামপন্থীদেরই একটা অংশ, তারা নিজেদের ব্যতিত অন্যদের কোনোভাবেই হকপন্থী মনে করেন না। সেই অংশের প্রবল আপত্তির মুখে এক ইউনিক আইডিয়া কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হলো। সর্বজনীন ইসলামি সাহিত্য মেলা এখন স্রেফ একটা নির্দিষ্ট ভাইদের মাদরাসার সীমানায় আবদ্ধ হয়ে পড়ল।
উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা সরে দাঁড়িয়েছিলাম। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম, আমাদের মিনিমাম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না হোক, অন্তত তারা আমাদের ডেকে নিয়ে ত্রুটিগুলো নিয়ে নসিহাহ করতে পারতেন। সামনে বসে রেখে আমাদের আরও ভালো মানের মুসলমান হওয়ার দুআ করতে পারতেন। বিনা নোটিশে ৩/৪টি প্রকাশনীকে বাদ দিয়েছে। নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল, জাস্ট ঝেড়ে দিয়েছে। খুব করে ভাবি, এই সম্মানিত মানুষদের হাতে যদি বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিয়ন্ত্রণ থাকত, তাহলে সেখানেও কি আমরা স্টল বরাদ্দ পেতাম? উল্টো করে বলি, তখন কি সেক্যুলার কোনো পাবলিকেশন আদৌ স্টল বরাদ্দ পেত?
সত্যিই কিতাবমেলাকে মিস করি! আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, মাদরাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ চত্ত্বর থেকে শহরতলীর সর্বত্র ইসলামি সাহিত্য ছড়িয়ে দিব। সকল মত ও চিন্তার কথামালা সবাই পড়ুক, জানুক, বুঝুক। চিন্তার দূরুত্ব কমে যাক, আন্তঃচিন্তার মুআমেলাত হোক। জাহেলিয়াতের সাহিত্যিক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় বিশ্বাসীদের সাহিত্য ভাণ্ডার দূর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়ুক ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে।
এখনও কিতাবমেলা চলছে। আলহামদুলিল্লাহ, বেশ কয়েকটি ইসলামি প্রকাশনী সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন পাঠকদের দোরগোড়ায় ইসলামি সাহিত্য পৌঁছে দিতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই প্রচেষ্টাকে আরও সফল করুন।
জাস্ট আমরাসহ আরও কয়েকটি প্রকাশনীকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। সরে দাঁড়ানোর সময়ে এক কঠিন সত্য হজম করেছিলাম। একটা মাদ্রাসার বারান্দায় কিছুটা ভিন্নমতের ( কিন্তু একই আদর্শের) মানুষদের আমরা সহ্য করতে পারি না। সেই আমরাই আবার বাংলা একাডেমির একদেশদর্শীতা ও অন্ধ চোখ নিয়ে প্রশ্ন তুলছি।
দাড়ি লম্বা নয় বলে একটা প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকে আমার সীমানায় বরদাশত করছি না। তাহলে ক্লিন সেভড সেক্যুলার সমাজ কেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লম্বা দাড়ি আর সফেদ টুপি-পাঞ্জাবি- পাগড়ি পরা মানুষদের জায়গা করে দিবে?
একই আদর্শ (কিন্তু কর্মকৌশলে ভিন্নতা) অনুসরণকারীদের ধারণ করতে আমরা নারাজ, সেখানে বিপরীত আদর্শের বরকন্দাজরা কেন আপনাকে ধারণ করবে?
আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম, সেক্যুলাররা কেন আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী বলে গালি দেয়। সেদিনই বুঝেছিলাম, সুযোগ ও ক্ষমতা পেলে ইসলামপন্থীরাও কতটা স্বৈরতান্ত্রিক হতে পারে।
আরও বুঝেছিলাম, সুযোগের অভাবে আমরা ভদ্র, ইনসাফকারী। একটু সুযোগ পেলে মতভিন্নতাকে গলা টিপে হত্যা করতাম।
বাংলা একাডেমি আত্মস্বীকৃত সেক্যুলার চিন্তাধারার রিপ্রেজেনটেটিভ। তাদের কাছে প্রত্যাশা করার কিছু নেই। আলোর মশালবাহী দাবিদার, উদার আদর্শের স্বীকৃত উপস্থাপকদের কাছেই প্রত্যাশিত ইনসাফ খুঁজে ফিরতে হয়, বাংলা একাডেমি তো দিল্লি দূর অস্ত...।