প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিকদের সাথে চা’চক্র করেছেন। টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর তিনি রাজনীতিক এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানান চায়ের টেবিলে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এবং ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। তারা গণভবনের চা পান করেননি।
আওয়ামীলীগ সমর্থক বা বর্তমানের আওয়ামী রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনীতিকরা প্রধানমন্ত্রীর চা আমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন। তারা গণভবনে গিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে চা পান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দেয়া রাজনীতিকদের মধ্যে একঝাক ইসলামপন্থী রাজনীতিকও ছিলেন। তারা সেখানে কী কী বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেছেন তা আমি জানি না। কিন্তু তাদের আলোচনা বা আড্ডা যে প্রাণবন্ত ছিল এর প্রমান মিলেছে। চা চক্রের অল্প সময় পরেই সোস্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী এবং ধর্মমন্ত্রীর সাথে কজন আলেম রাজনীতিকগণ হাস্যোজ্জল কথাবার্তা বলছেন।
যদ্দুর জানি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঠখোট্টা মানুষ নন। চায়ের টেবিলে তিনি বেশ খোলামেলা আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। মন খুলে কথা বলেন, টিপ্পুনি করেন। সুতরাং আলেম রাজনীতিকদের সাথে তার চা চক্র বা চা আড্ডা নিঃরস হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া শোনা যায় তিনি ব্যক্তিগত ভাবে আলেমদের প্রতি অনেক শ্রদ্ধাশীল। যে আলেমগণ চা খেতে গিয়েছিলেন তারাও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি, তার রাজনীতির প্রতি, শাসন পদ্ধতির প্রতি বেশ আস্থাশীল। একাদশ নির্বাচনের আগে তারা ‘ঐদিকে’ যেতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ বিগত দিনের রাজনৈতিক বন্ধু বিএনপিকে ছেড়ে তারা আওয়ামীলীগের পাণিগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তাদের অনেকেই নৌকা মার্কায় নির্বাচন করার জন্য দৌড় ঝাঁপ করেছিলেন। দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির খোঁজখবর রাখেন এমন অনেকের ধারনা ছিল- ওই আলেমদের দুই একজন নৌকার টিকেট পেতে পারেন। কিন্তু তা হয়নি। আওয়ামীলীগের নমিনেশন ঘোষনার পর দেখা যায় তাদের কেউই নৌকার টিকেট পাননি। যা শ্রদ্ধেয় আলেমগণকে হতাশ করেছিল। তারা এক প্রকার পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছিলেন। সম্ভবত চক্ষুলজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সাথে চা চক্রের পরে তারা সে হতাশা বা লজ্জা কাটিয়ে উঠেছেন বলেই মনে হয়েছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের নামে দেশে যা করা হয়েছে তাকে কোনো ভাবেই নির্বাচন বলা যায় না। এতে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। মানুষ ভোট দিয়ে শাসক নির্বাচন করতে পারেনি। ওই ভোটের মাধ্যমে মানুষের জাতীয় অধিকার হরণ করা হয়েছে। ফলে দেশের শাসনব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা এবং প্রশাসন কোনো কিছুই আর জনগণের পক্ষে থাকেনি বা থাকতে পারেনি। এতে দেশের মানুষ চরম অসম্মানবোধ করেছে। শাসকশ্রেণীর প্রতি মানুষের মনে তীব্র এক অশ্রদ্ধা তৈরী হয়েছে। ক্ষমতার মোহে আওয়ামীলীগ হয়তো এখন তা বুঝতে পারছে না বা বোঝার চেষ্টা করছে না। কিন্তু একদিন তারাও বুঝতে পারবে। বুঝতে তাদের হবে। কারন একাদশ জাতীয় নির্বাচন আওয়ামীলীগ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে খুব খারাপ বার্তা দিয়েছে, যা দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর হবে।
বিএনপি এবং ইসলামী আন্দোলন দেশের গণমানুষের মনের ভাষা পড়তে পেরেছে। সুতরাং তাদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর চা আমন্ত্রণ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তারা জাতীয় বিবেকের উপর পা রেখে গণভবনে যেতে পারেননি। কিন্তু যারা চা আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন, তারা মূলত জাতীয় বিবেক পদদলিত করেছেন। গণপ্রত্যাশার প্রতি চরম অশ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। দেশের গণমানুষের সাথে অসৌজন্যতা করেছেন। বিশেষ করে যে আলেমগণ প্রধানমন্ত্রীর সাথে চা খেতে গিয়েছেন, হাস্যোজ্জল ছবি তুলেছেন তারা কী একবারও ভেবেছেন, দেশের গণমানুষ কী ভাবছে? এই মুহুর্তে জাতীর প্রত্যাশা কী?
আমি জানি দেশের রাজনীতিতে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। দেশের একশতাংশ মানুষেরও প্রতিনিধিত্ব আপনারা করেন না। এই বিবেচনায় আপনারা প্রধানমন্ত্রীর চা দাওয়াতে যান বা কাঙ্গালী ভোজে যান তাতে খুব বেশি কিছু এসে যায় না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা দরকার ছিল, আপনারা আলেম। আপনারা নিজেদের নায়েবে রাসুল (স) দাবি করেন। রাজনৈতিক ভাবে আপনারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেউ না হলেও ধর্মীয় ভাবে অনেক কিছু। আলেম হিসাবে দেশের মানুষ আপনাদের শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। আপনারা দেশের সাধারণ মানুষের এই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা পদদলিত করে রাজপিয়ালায় চুমুক দিতে পারেন না। আপনাদের মনে রাখা দরকার ছিল, ক্ষমতাই জীবনের শেষ কথা নয়।
দেশে সুশাসন নেই। মানুষের অধিকার নেই। নিরাপত্তা নেই। প্রশাসন এবং জনগণ পরস্পর এখন প্রতিপক্ষ। কেউ কারো অধিকার এবং সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। নির্বাচন নামের প্রহসন করে প্রধানমন্ত্রী গণমানুষের গণআস্থা হারিয়েছেন। মানুষের বুকের গভীরে চাপা ক্ষোভ তুষের আগুনের মতো জ্বলছে। এমন একটা নাজুক মুহুর্তে কীহতো ওই চা চক্রে না গেলে? জেল খাটতে হতো? আপনাদের নামের পুরনো মামলাগুলো সচল করা হতো?
বিশ্বাস করুন- ওখানে গিয়ে, হাস্যোজ্জল ছবি তুলে আপনারা যে গণধিক্কার কুড়িয়েছেন তারচেয়ে হাজতখাটা অনেক সম্মানের এবং স্বস্তির হতো।
পলাশ রহমান : লেখক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট