নুর আহমেদ সিদ্দিকী
স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাসে ভারত অভিমুখে তিনটা লংমার্চ অনুষ্টিত হয়।সেই তিন লংমার্চের নেতৃত্বে ছিলেন তিনজন যুগ সচেতন বিখ্যাত আলেম। তারা হলেন মাজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণী,শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক,মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাই। এগুলো ছিলো ইতিহাসের ঐতিহাসিক লংমার্চ।
একঃমাওলানা ভাষাণীর ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে লংমার্চঃ
১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে একতরফা গঙ্গার জল অপসারণের মাধ্যমে পদ্মা নদীকে পানি শূণ্য করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলার আহবান জানান বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণী। দেশ ব্যাপি তিনি বিভিন্ন মিছিল মিটিং সমাবেশ করে প্রথমে দেশবাসীকে সচেতন করে তুলেন।এরপর ডাক দেন ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক লংমার্চ।১৯৭৬ সালে ১৬ মে মাওলানা ভাষাণীর নেতৃত্বে পদ্মানদীর তীরবর্তী রাজশাহী বিভাগীয় শহর থেকে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে লংমার্চের যাত্রা করেন।মাওলানা ভাষাণীর ইচ্ছা ছিল ভারতের অভ্যন্তরে তথা ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত লংমার্চ নিয়ে যাবেন কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পরামর্শে ভারতের অভ্যন্তরে যায়নি লংমার্চ।১৯৭৬ সালের ১৭ মে অপরাহ্নে ভারতীয় সীমান্তের কাছে কানসাটে গিয়ে ফারাক্কা অভিমুখের লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন মাওলানা ভাষাণী। তিনি ইসলাম, দেশ মানবতার জন্য আমরণ সংগ্রাম করে গেছেন।মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণী একজন দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন।দেশের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হলে তিনিই সবার আগে প্রতিবাদে রাজপথে নামতেন।তিনি আমৃত্যু ইসলাম, দেশ,মানবতা ও মজলুমের পক্ষে সংগ্রাম করেছেন।সয়েয়েছেন বহু নির্যাতন।শিকার হয়েছেন জুলুমের।এই জন্য মরণোত্তর মজলুম জননেতা।
দুইঃশায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক এর বাবরী মসজিদ অভিমুখে লংমার্চঃ
ভারতের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার লংমার্চ করেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ।১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত ৫শ বছরের ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ উগ্র হিন্দুত্বাদীরা শহিদ করে দেয়।সাথে সাথে মুসলমানদের উপরও চালানো হয় গণহত্যা।সেটা সহ্য করতে পারেনি বাংলাদেশের যুগ বিখ্যাত বুজুর্গ ও ইসলামী রাজনীতিবিদ শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ।এর প্রতিবাদে দেশ ব্যাপি তিনি গণ আন্দোলন গড়ে তুলেন।তিনি ভারতের অযোধ্য অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দেন।ঢাকায় তৌহিদী জনতার উত্তাল বাঁধা ভাঙ্গা জোয়ার সেদিন বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।১৯৯৩ সালের ২ জানুয়ারি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ এর নেতৃত্বে ঢাকা থেকে লক্ষাধিক জনতার লংমার্চ যাত্রা করে অযোধ্য অভিমুখে।লাখ জনতার মিছিল খুলনা পৌছে ভারতের সীমান্তের দিকে যেতে চাইলে ভারতীয় বিএসএফ বৃষ্টির ন্যায় গুলি বর্ষণ করে।সেখানে দুইজন শহিদ হয়।বলতে গেলে শায়খুল হাদিস রহ এর এই লংমার্চ ইসলামী বিশ্বে প্রসংশিত হয়েছিল।
তিনঃটিপাইমুখ অভিমুখে পীর সাহেব চরমোনাইর লংমার্চঃ
ভারত আদৌ বাংলাদেশের বন্ধু নয় যদিও তারা বন্ধু রাষ্ট্র বলে গলাফাটাই।কিন্তু বাস্তবে শত্রু দেশের মত আচরণ করে।স্বাধীনতার পর থেকে ভারত- বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশের হাজারো নীরহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।ফারাক্কা থেকে টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র কোন বন্ধু রাষ্ট করতে পারেনা যা ভারত করেছে।১৯৭৫ সালে ২১ এপ্রিল ফারাক্কা বাঁধ এবং ২০০৯ সালে এসে টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশের সাথে শত্রু দেশের ন্যায় আচরণ করেছে।টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার প্রতিবাদে দেশব্যাপি আন্দোলনের ডাক দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম পীর সাহেব চরমোনাই। তিনি প্রথমে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।এরপর প্রতিটি থানায় বিক্ষোভ মিছিল করে দেশবাসীকে সচেতন করেন।এরপর ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও করেন।সর্বশেষে তিনি ২০০৯ সালের ২৪,২৫, ২৬, ডিসেম্বর তিন দিন ব্যাপি ভারতের টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চ ঘোষণা করেন।ঢাকার মুক্তাঙ্গন থেকে লাখ লাখ জনতার লংমার্চ শুরু হয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ পাটগ্রামে গিয়ে তিন দিন ব্যাপি ঐতিহাসিক লংমার্চ সমাপ্তি ঘোষণা করেন পীর সাহেব চরমোনাই।মাওলানা ভাষাণীর লংমার্চে বাংলাদেশ সরকারের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকলেও ২০০৯ সালে পীর সাহেব চরমোনাই টিপাইমুখ অভিমুখের লংমার্চে আওয়ামী লীগ সরকারের কোন ধরণের সহযোগিতা ছিলনা।দেশের স্বার্থে যেহেতু লংমার্চ সেহেতু সরকারের উচিত ছিল লাখ লাখ জনতার খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো।কিন্তু সরকারের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।পীর সাহেব চরমোনাইর টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চের পর ভারত সরকার টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।এতেই প্রমাণিত হয় আলেম ওলামা দেশপ্রেমিক।মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষাণীর পরে সবচেয়ে দেশপ্রেমিক আলেম রাজনীতিবিদ হলেন পীর সাহেব চরমোনাই।বর্তমানে সময়ে অনেক দলের নেতাকে দেশপ্রেমিক বলা হলেও বাস্তবে তারা ক্ষমতালিপ্সু।২০০৯ সালের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভারতের টিপাইমুখের বাঁধ নিয়ে কার্যকর কোন আন্দোলন করেনি।ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপির তেমন শক্তিশালী অবস্থান কখনোই ছিলনা।আজ তারা দেশপ্রেমিক হলেও অন্যদের দেশপ্রেমিক ভাবতে নারাজ।ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সূচনালগ্ন থেকে ইসলাম,দেশ ও মানবতা ও স্বাধীনতার পক্ষে রাজনীতি করে আসছে।সেই জন্যে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে তারাই সবার আগে রাজপথে নেমেছে।২০২৪ সালের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যানার নিয়ে রাজপথে ছিলো পীর সাহেব চরমোনাই ও তাঁর দল।সুতরাং একথা বলতে দ্বিধা নেই যে,পীর সাহেব চরমোনাই একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও আধ্যাত্মিক রাহাবার।
লেখকঃ কলামিস্ট ও সমাজকর্মী