আশরাফ আলী ফারুকী
বাংলাদেশে জাতিসংঘের নতুন আবাসিক সমন্বয়ক হিসেবে একজন সমকামী কূটনীতিকের নিয়োগ ঘিরে দেশব্যাপী চরম বিতর্ক, অস্বস্তি ও কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পাপুয়া নিউগিনিতে কর্মরত জাতিসংঘ কর্মকর্তা রিচার্ড এস. হাওয়ার্ডকে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অ্যাগ্রিমো চাওয়া হয়েছে, যা কূটনৈতিকভাবে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। কিন্তু হাওয়ার্ড একজন খোলাখুলি সমকামী এবং তিনি তার সমলিঙ্গের জীবনসঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশে আসতে চান—এই খবর সামনে আসতেই ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমকামিতা এখনও অপরাধ। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী সমলিঙ্গের যৌন সম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। পাশাপাশি বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতি এখনও ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক রক্ষণশীল অবস্থান ধরে রেখেছে, যেখানে সমকামী জীবনধারা ব্যাপকভাবে নিন্দিত ও অগ্রহণযোগ্য। এমন বাস্তবতায় জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তকে অনেকে একটি সচেতন সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। ধর্মীয় সংগঠন খেলাফত মজলিস বিষয়টিকে ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ বলে অভিহিত করে বলেছে, জাতিসংঘ এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক ভারসাম্য, ধর্মীয় অনুভূতি এবং সাংস্কৃতিক স্বার্বভৌমত্বে সরাসরি আঘাত করেছে। তারা এই নিয়োগ অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। তাদের ভাষায়, “জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত ইসলাম ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নামান্তর। এই ধরনের বিতর্কিত ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ মনোনয়ন আমাদের দেশপ্রেমিক জনগণ মেনে নেবে না।”
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম শহীদুজ্জামান এই নিয়োগের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, “জাতিসংঘ কীভাবে এমন একজন বিতর্কিত প্রার্থীকে মনোনয়ন দিল, তা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশে ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই মনে হচ্ছে। জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে এই অ্যাগ্রিমো প্রত্যাহার করা।” তিনি এটিকে শুধু একটি ব্যক্তি নিয়োগ নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক বার্তা হিসেবেও দেখছেন, যা ভবিষ্যতে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলতে পারে বলে সতর্ক করেছেন।
এদিকে জাতিসংঘ এই বিষয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। তবে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সরকার বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অ্যাগ্রিমো দেওয়া হবে কি না, তা এখনো চূড়ান্ত নয়। কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে, এই মনোনয়ন সরকার গ্রহণ না করলেও তা আন্তর্জাতিকভাবে অস্বাভাবিক বিবেচিত হবে না, কারণ আগেও নানা দেশে ধর্মীয় বা সামাজিক কারণে অ্যাগ্রিমো প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন, “এটি আমাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা”, আবার কেউ বলছেন, “জাতিসংঘ মানবাধিকার ও বৈচিত্র্যের কথা বলে, কিন্তু তারা কি কখনও স্থানীয় ধর্মীয় ও আইনি বাস্তবতা বিবেচনা করে?” অনেকে আবার মনে করছেন, “এটি একটি পরিকল্পিত উত্তেজনা তৈরির প্রচেষ্টা, যাতে বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক চাপে ফেলা যায়।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘের নিয়োগনীতিতে বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলকতা গুরুত্বপূর্ণ হলেও প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব আইন, সামাজিক কাঠামো ও ধর্মীয় আবেগকে উপেক্ষা করা আন্তর্জাতিক কূটনীতির চরম অসতর্কতা। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে অস্থিরতা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা থেকে জাতিসংঘের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এমন এক সময়ে যখন জাতিসংঘ ঢাকায় মানবাধিকার অফিস স্থাপন নিয়ে জটিলতা পেরোচ্ছে, তখন নতুন একটি বিতর্কিত মনোনয়ন কূটনৈতিকভাবে তাদের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।
এখন প্রশ্ন উঠছে—জাতিসংঘ কি তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করবে, নাকি বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে? আর বাংলাদেশ সরকারই বা কী সিদ্ধান্ত নেবে? আপাতত এই নিয়োগ ঘিরে দেশে উত্তেজনা, ক্ষোভ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে—যার উত্তর হয়তো দেবে আগামী কূটনৈতিক কয়েক সপ্তাহ।