নিজস্ব প্রতিবেদক:
আজ ৮ ই জুন ২০২১ সম্পন্ন হয়েছে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে দ্বায়িত পালন করার মেডিকেল কলেজের শেষদিন। এই এমবিবিএস ডাক্তার হয়ে ওঠার রাস্তাটি কখনই মসৃণ ছিলো না। আজ জানবো এই ডাক্তার হয়ে ওঠার পিছনের কথাগুলো।
প্রাইমারী স্কুল জীবন থেকেই মেধাবী ছাত্রী হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন তিথী। জীবনের প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষার অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হন তিনি। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেনীতে বৃত্তি পরীক্ষায় সবাইকে তাক লাগিয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পান তিথী। তখন থেকেই নিয়মিত স্বপ্ন দেখতেন তিনি একদিন ডাক্তার হবেন। মজার বিষয় হচ্ছে তিনি স্কুল জীবনে যতবারই, “জীবনের লক্ষ্য বা Aim in Life” রচনা লিখতেন ততোবারই ডাক্তার হবেন লিখতেন। মাধ্যমিক স্কুলে তো অসংখ্য বার এই রচনা লিখতে হয়েছে। এক কথায় তিনি তার মাথায় জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন জীবনে ডাক্তারই হবেন। সেই ডাক্তার হবার জন্য নিরবধি ছুটে চলা এই আজকের দিন পর্যন্ত।
স্কুল জীবনে ডাক্তার হবার জন্য প্রথম ধাপ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া। তিনিও সেই ধাপ শুরু করেন গ্রামের একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সেখানও তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে এস.এস.সি পাশ করেন। সেখানে আরও একটি অন্যরকম সফলতার গল্প। যা ইতিহাস করেছেন। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (মোকামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়) এর তিনিসহ আরেকজন প্রথম বারের মত এই স্কুলের হয়ে গোল্ডেন এ প্লাস (A+) অর্জন করেন। আর এই সফলতার পরে তার ডাক্তার হবার পথে একধাপ এগিয়ে যান।
এরপরেই জীবনে চলে আসে একটি পরিবর্তন। যা তাকে মাতৃস্নেহ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। তার কারনটা অবশ্যই পড়াশোনার জন্য অন্য আরেক জেলা শহরে মামার বাড়িতে পাড়ি জমান তিথী। এস.এস.সিতে ভালো ফলাফল করার পরে এইচ.এস.সিতেও আরো ভালো করার জন্য ভালো মানের কলেজে পড়ার জন্যই এই স্থানান্তর। জন্মের পর থেকেই এই প্রথম বাবা মায়ের কাছে থেকে দূরে আসা শুধু পড়াশোনার জন্য।
পিরোজপুর সরকারি মহিলা কলেজ, পিরোজপুরে ভর্তি হন বিজ্ঞান বিভাগে। শুরু হয় নতুন এক জীবন সংগ্রাম। তবে তিনি স্থির ছিলেন তার জীবনের লক্ষ্যে। ডাক্তার হবার জন্য নিয়মিত পড়াশোনা, ক্লাস, প্রাইভেট আর কঠোর পরিশ্রম। এভাবে চলতে চলতে সামনে চলে আসে এইচ.এস.সি পরীক্ষা। তখন সারা দেশ উত্তাল ছিলো হরতাল ও অবরোধে। তার মধ্যেও বিভিন্ন রকমের সিডিউল বিপর্যয়ের মধ্যেই শেষ হয় তিথীর এইচ.এস.সি পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে আবার তার সেই আগের ধারাবাহিতায় চমৎকার সাফল্য বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫.০০ লাভ করেন।
তবে এর পরেই শুরু হয় আসল যুদ্ধ। যার নাম ভর্তিযুদ্ধ বা ভর্তিপরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করার জন্য আবারো প্রস্থান করেন নতুন এক শহরে। যেখানে আগে কখনোই যান নাই। সেই খুলনা বিভাগীয় শহরে শান্তিধাম মোড়ে ফুল মার্কেটের ওখানে।মেসে উঠে পড়েন কোচিং করার জন্য। নিয়মিতভাবে কোচিং ও পড়াশুনো চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ব্যার্থতার সাথে অকৃতকার্য হন প্রথমবার ২০১৩ সালে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায় তার এই ব্যার্থতায়।
তবে তিথী কখনো ভেঙে পড়ে নাই, থেমেও থাকেননি তিনি। নিয়মিতভাবেই পড়াশোনা করেছেন। সেকেন্ড টাইমার হিসাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন। আবারো মেডিকেল কোচিং করার জন্য ভর্তি হোন আরেক নতুন শহর বরিশালে। বিভাগীয় শহরে দেশের স্বনামধন্য রেটিনা কোচিং সেন্টারে। নতুন উদ্যমে পড়াশুনো করতে থাকেন আর স্বপ্ন দেখতে থাকেন যে, তাকে ডাক্তার হতেই হবে।
এমন করতে করতে করতে চলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নিজেকে প্রমান করার জন্য ২৪ অক্টোবর ২০১৪ মেডিকেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। তিথীও মেডিকেল পরীক্ষাতে অংশগ্রহন করলো তবে পরীক্ষা দেয়ার পরে তো বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা। কখন রেজাল্ট দিবে? পরীক্ষা কেমন হয়েছে? কতটি দাগাতে পেরেছো? এই দু’দিন এমনি চলতেই থাকে। অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মেডিকেল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো ২৬ অক্টোবর ২০১৪ দুপুরের দিকে। তখন তো স্মার্টফোন এতটা সহজলভ্য ছিলো না। রেজাল্ট দেখার জন্য সবাই ছটফট করতেছে। হঠাৎ করেই জানতে পারি আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি। জামালপুর মেডিকেল কলেজ।
অবশেষে একটু শ্বাস নিতে পারলাম প্রণভরে। আর এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সব থেকে আনন্দের এই দিনটিই যখন শুনেছি MBBS এ চান্স পেয়েছি। চান্স পাবার পরে অবশ্যই মাইগ্রেশন করে ভর্তি হই গোপালগঞ্জ শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজে। সেখানেই এমবিবিএস সম্পন্ন করেন আর হয়ে ওঠেন একজন ডা: তিথী রানী। এই সব সফলতার পিছনের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন বাবা। যিনি কখনই আঁচ লাগতে দেননি কোন কিছুতেই। যখন প্রাইভেট, কোচিং বা বিভিন্ন ধাপে অনেক টাকা লাগতো তখন বাবা সব কিছুই ম্যানেজ করতো। কখনো কোন কিছুতেই কস্ট দেন নাই সন্তানদের। আজকের আমার এইদিনে কোন কস্টের কথা বলতে চাইনা বা পরিশ্রমের কথাও না। তাই শুধুই সফলতার কথাই বললাম আজ।
প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাই, এতো সব সফলতা পিছনের কথা, আপনি কখনো হতাশ হয়েছেন বা আপনাকে দিয়ে এসব হবেনা এমনটা ভেবেছেন?
উত্তরে ডা: তিথী রানী বলেন, হতাশ যে কখনই হয়নি সেটি বলব না, তবে নিজের উপরে সর্বোদাই আস্থা ছিলো যে আমি পারবো। এখন একটা কথা বলি, মেডিকেলে চান্স পাবার পরে পড়াশুনো শুরু হবার পরেই এতো এতো মোটা মোটা বই এতো সব পড়া তখন কিছুটা হতাশ হতাম। তবে যখন পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতাম তখনই সব ভুলে যেতাম। আরেটা মজার বিষয়ে ছিলো যে, মেডিকেল কলেজ জীবনে কখনই ফেল করিনি। এটাও অন্য রকম প্রাপ্তি জীবেনর।
পাবলিক ভয়েস ২৪ তার কাছে সরাসরি জানতে চাইলো, আজ আপনি এমবিবিএস সম্পন্ন করলেন এবং ডাক্তার হলেন। আজকের আপনার এই সফলতার পিছনে কাদের সহযোগীতা পেয়েছেন বা কাদের স্মরণ করতে চান ?
উত্তরে ডা: তিথী রানী বলেন, আমি তো সবার আগে স্মরন করি আমার বাবা, মা ও বড় মামাকে তারাই আমার সফলতার নেপথ্যের আসল কারিগড় তাছাড়া আমার জীবনের সকল শিক্ষকদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করছি যারা বিভিন্ন পর্যায় আমাকে পড়িয়েছেন সেই সকল স্যারদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
ইন্টার্ন শেষ তো হলো, এখন কি করবেন?
ডা: তিথী বলেন, কিছুদিন পরেই বরিশালে একটি প্রাইভেটে ক্লিনিকে বসার কথা রয়েছে, বাবা সেসব বন্দোবস্ত করতেছে। আর আমার বাবা তো পল্লী চিকিৎসক, বাবার ওখানে বসতে বলেছেন প্রতি সপ্তাহে তাই করবো, আর কি পড়াশুনা করবো বিসিএস দেয়ার জন্য।
সরকারি মেডিকাল কলেজে পড়াশুনো করে ডাক্তার হলেন, এককথায় বলা যায় দেশের জনগনের টাকায় পড়েছেন, এই সাধারণ জনগনের প্রতি দায় বোধ থেকে তাদের জন্য কি করবেন, কিছু ভেবেছেন বা প্লান আছে ?
উত্তরে ডা: তিথী রানী বলেন, তেমন কিছুই ভাবিনি এখনো, তবে ডাক্তার তো মানুষের সেবা করার জন্য। সেটা করার চেষ্ঠা সর্বোদাই অব্যাহত থাকবে। রোগীর চেয়ে রোগকে গুরুত্ব দিয়েই কাজ করতে হবে।
সর্বশেষ প্রশ্ন, আপনি ডাক্তার হয়েছেন আজ, এখন নতুন যারা এই পেশায় আসতে চায় বা মেডিকেলে চান্স পেতে চায় তাদের উদ্দেশে কিছু বলার আছে তো নির্দেশনা দিবেন?
উত্তরে, একটু হেসে ডা: তিথী রানী বললেন, এমন বড় কিছুই হয়নি এখনো যে কিছু বলব বা নির্দেশনা দিবো, তবে এইটুকু বলতে পারি যে, নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম থাকলেই সব কিছুই সম্ভব হয় বলে আমার বিশ্বাস।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ডাঃ তিথী রানী, এম.বি.বি.এস(ঢাকা)
পি.জি.টি (এস এস কে এম সি)।
নাজমুল/