আতিকুল ইসলাম, জবি:
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় থমকে গেছে বিশ্ব, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। দেশে করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ায় গত মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বসে বসে অলস সময় পার করতে হচ্ছে লাখো শিক্ষার্থীকে। এছাড়াও করোনাকালীন সময়ে শিক্ষিত ১.৫ লাখ বেকারের চাকরীর বয়সসীমা পার হয়েছে কিন্তু চাকরী মেলেনি। এখন তাদের অনেকেই হতাশার মাঝে দিন নিপাত করছেন। কিন্তু এই বিরূপ পরিস্থিতিতেও থেমে থাকেননি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরমান হাসান। করোনাকালীন সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স চতুর্থ বর্ষে এসে করোনার কারণে থেমে যায় পরীক্ষা। চলে যান গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। সেখানে যখন শ্রমিকের অভাবে অধিকাংশ কৃষকের ধান কাটা বন্ধ ছিল তখন আরমান কৃষকদের এ দুঃখ লাঘবের জন্য যোগাযোগ করেন উপজেলা কৃষি অফিসে। সেখান থেকে সরকারি প্রণোদনায় কেনেন আধুনিক রিপার (ধান কাটার মেশিন)। গত আমন মৌসমেই রিপার দিয়ে লাভ করেন প্রায় ১ লক্ষ টাকা। মূলত এ সময় থেকেই তার কৃষিতে যাত্রা শুরু।
আরমান হাসান জানান, একর প্রতি জমিতে যেখানে ধান কাটার খরচ ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা সেখানে রিপার মেশিনে ধান কাটার খরচ হয় মাত্র ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা। চলতি বোরো মৌসমে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে আরো একটি রিপার নিয়ে ধান কাটা শুরু করেন তিনি। বর্তমানে ২টি রিপার মেশিন দিয়ে ধান কাটেন তিনি। একটি ধান কাটার মেশিন থেকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয়ও হয়ে থাকে। নির্ভরযোগ্য আয়ের সন্ধান পেয়ে করোনাকালীন সময়ে কৃষিকাজেই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেন আরমান।
এছাড়াও উপজেলা কৃষি অফিস থেকে শেখেন বিভিন্ন ফসল চাষবাদের কৌশল। তাদের সহযোগিতায় প্রায় ৩ একর জমিতে আঁখ ও আখেঁর ফাঁাকে সাথী ফসল হিসেবে আলুর চাষ করেন তিনি। শুধু আলু থেকেই চাষাবাদের খরচ উঠে আসে এবং আঁখ থেকে বার্ষিক ১৫ লাখ টাকা আয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ও বীজ ব্যবহার করে টমেটো, আঁদা,লেবু, সরিষা, জিংক সমৃদ্ধ ধান (ব্রি-ধান ৭৪ ও ৮৪) চাষ করেছেন। এছাড়াও বাড়ির পাশে ১ বিঘা জমিতে তৈরি করেছেন মাল্টা ফলের বাগান। এ বছর জমি ভাড়া নিয়ে তার কৃষি কাজের আরো বিস্তৃতি করবেন বলে জানান তিনি।
তার বাবা আত্মপোষণের জন্য কৃষিকাজ করে পরিবারের খরচ মেটাতো। এখন আরমান তার পরিবার বাদেও অনেক পরিবারের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তার কৃষি কাজে প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ১০ জন লোক কাজ করেন।
তিনি বলেন, 'অনেকে মনে করে কৃষিকাজে তেমন আয় নেই। সঠিক চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারলে বড় অঙ্কের টাকা আয় করা সম্ভব। শিক্ষিতদের কৃষি কাজ করা উচিৎ। সরকারিভাবে ধান বিক্রি করতে চাইলেও অ্যাপের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়। তাই আইটি বিষয়ে কৃষকদের ভালো ধারণা থাকা জরুরী। এসব বিষয়ে অজ্ঞ কৃষকেরা নিজেদের পেট চালাতেই হিমসিম খান। এক্ষেত্রে শিক্ষিত যুবকরা এগিয়ে আসলে খুব সহজেই তারা নিজেদের ও কৃষির উন্নয়ন সাধন করতে পারেন। শিক্ষিত কৃষক ইন্টারনেট, ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিভিন্ন ফসলের সঠিক চাষাবাদ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, করোনা শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন কারণে ৬২ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। কৃষি কাজের সাথে জড়িতরাই কেবল যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম। কেননা কৃষি কর্মকর্তারা যে চাষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে বলেন সেভাবে অনুসরণ করতে পারলে যে কোন দুর্যোগকালীন সময়ও মূলধন তুলে আনা সম্ভব। এতে শিক্ষিত কৃষকদের বিলীন হয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
তিনি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা খুবই আন্তরিক। যে কোনো কৃষক তাদের কাছে গিয়ে উপকৃত হতে পারে। আমার কৃষি কাজে উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে সব চেয়ে বড় অবদান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের। তারা আমাকে সব সময় সঠিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তাদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ।
আরমান হাসান এর গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার রাণীশিমূল ইউনিয়নের মালাকোচা গ্রামে। তিনি ২০১৪ সালে ভায়াডাঙ্গা সিনিঃ আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও ২০১৬ সালে শেরপুর ইদ্রিসিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাশ করেন। বর্তমানে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনার্স ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।
উপজেলা কৃষি অফিসার হুমায়ুন দিলদার বলেন, আরমানের মতো আরো যারা নতুন উদ্যোক্তা আছে আমরা তাদের বীজ দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে থাকি। সামান্য পরিমাণ জমি দেখাতে পারলেও তাদের প্রদর্শনী বীজ দেওয়া হয়। তিনি তাদের উচ্চমূল্যের ফসল, মাল্টাসহ অন্যান্য ফসল চাষে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। কেননা এসব ক্ষেত্রে অল্প সময়ে ভালো আয় করা সম্ভব।
নাজমুল/