ফাইজুল ইসলাম ফাহিম:
"মানুষকে আমি ঘৃণা করি না
কিন্তু ক্ষুধার্ত হলে
জবরদখলকারীর মাংসই হবে আমার খাবার"- মাহমুদ দারবিশ
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম গ্যালিলির আল-বিরওয়া গ্রামে ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ মাহমুদ দারবিশের জন্ম। তাঁর পিতা সালিম দারবিশ, মা হুরিয়াহ দারবিশ। তাঁরা ছিলেন কৃষক, নিজেদের জমিতে চাষবাস করতেন। ১৯৪৮ সালে ইহুদিবাদী ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইসরায়েলি সৈন্যরা প্যালেস্টাইনিদের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। জোরপূর্বক দখল করে নেয় প্যালেস্টাইনি ভূমি। ধ্বংস করে দেয় তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য –সব। জাতিসংঘের হিসাবে সাত লাখ ছাবিবশ হাজার থেকে নয় লাখ প্যালেস্টাইনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। দারবিশের গ্রামও আক্রান্ত হয়, তাঁরা অন্যদের সঙ্গে পালিয়ে যান লেবাননে, সেখানে প্রথমে জেজিন, পরে দামুরে আশ্রয় নেন। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ইসরায়েলিরা তাদের বসতবাড়ি, ফসলি জমি ও বাগান সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলে, যেন আসল বাসিন্দারা অবরুদ্ধ গৃহবন্দী হতে হয়েছে।
মাহমুদ দারবিশ ১৯৪৮ সালে মাত্র ৭ বছর বয়সে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গৃহহীন হয়ে নিজের জন্মভূমিতে পরাধীনতার তিক্ত স্বাদ অনুভব করা শুরু করেন। তুখোড় কাব্য প্রতিভার অধিকারী কবি ১৯৫৩ সালে মাত্র বার বছর বয়সে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কবিতাটির ভাববস্তু ছিলো আবেগ, জিজ্ঞাসা আর আক্ষেপের বিস্ফোরণ। এক ইহুদি বালকের প্রতি আরব বালক মাহমুদ দারবিশের করুণ আবেদন-
“হে বন্ধু
তুমি তোমার খেয়াল খুশি মতো দিনের বেলায় খেলতে পারো
তুমি তোমার খেলনা বানাতে পারো,
তোমার যা কিছু আছে, আমার তার কিছুই নেই
তোমার বাড়ি আছে, আমার নেই,
আমি উদ্ধাস্তু ......।
আমরা কেন একসাথে খেলতেও পারব না?"
মাত্র বার বছর বয়সী পরাধীন এক কিশোর কবির এমন করুণ আর্তি যে কোন মানবতাবাদীর হৃদয়ে আন্দোলন সৃষ্টি করবেই। বছরখানেক পরে দারবিশের পরিবার প্যালেস্টাইনে ফিরে আসে অবৈধভাবে, কিন্তু না পারেন নিজ গ্রামে যেতে, না পারেন তাঁদের জমিজমা উদ্ধার করতে। তাঁরা শেষ পর্যন্ত দিয়ার আল-আসাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এই গ্রাম থেকে তাঁদের নিজেদের বেদখল হয়ে যাওয়া জমিজমা-বাগান সবই দেখা যেত। তাঁরা ফিরলেন বটে, কিন্তু ততদিনে ইসরায়েল জনজরিপ সম্পন্ন করে ফেলেছে। যেসব প্যালেস্টাইনি জরিপের সময় নিজ ভিটায় বসবাসরত ছিল তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকত্ব দেওয়া হলো। সে-সুযোগ দারবিশের পরিবার পায়নি। সুতরাং তাঁদের থাকতে দেওয়া হলো, কিন্তু তাঁদের আইনি স্ট্যাটাস হলো ‘উপস্থিত-অনুপস্থিত বহিরাগত’, অর্থাৎ না নাগরিক, না অ-নাগরিক। যেহেতু তাঁরা আছেন, সেহেতু উপস্থিত; কিন্তু অনুপস্থিত এ-কারণে যে, ‘সঠিক’ সময় তাঁরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। জায়নবাদী ইসরায়েল কর্তৃক আবিষ্কৃত এ এক অভূতপূর্ব পরিচয়পত্র। এই পরিচয়পত্রের বলে দারবিশের পিতা ওয়ার্ক পারমিট পেলেন।
তাঁর প্রাথমিক জীবনে লেখা যেসব কবিতা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তার মধ্যে ‘পরিচয়পত্র’ বিশেষ জনপ্রিয়। এটা ২০ বছর বয়সে লেখা। এই কবিতায় দারবিশ আগ্রাসনের শিকার প্যালেস্টাইনিদের সত্যিকার দুর্দশাকে শনাক্ত এবং তাকে প্রত্যাখ্যানও করেছেন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যেমন সৃষ্টিকর্তার অহি এসেছিল – ইক্করা! – পড়ো!, তাকে অনুসরণ করে তিনি বলেছেন, সাজ্জিল! – লেখো!
তারপর তিনি বলছেন, আমি একজন আরব। তিনি গর্ব করে বলছেন, তাঁর আটটা সন্তান, আরেকটার জন্ম আসন্ন, তাদের ত্রাণের দরকার নেই, তাঁর পিতা কৃষক পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারী –
‘তোমরা আমার পূর্বপুরুষের বাগান চুরি করে নিয়েছ
যে জমি আমি চাষ করতাম আমার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে’।
এভাবে তিনি ইহুদিবাদী প্রকল্পকে চুরি-ডাকাতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তিনি শান্তি চান, বলেন – ‘আমি মানুষকে ঘৃণা করি না’। আবার একই সঙ্গে সতর্ক করেও দেন এই বলে –
সাবধান হও…
“আমার ক্ষুধা থেকে
এবং আমার ক্রোধ থেকে।
তাঁর এই কবিতাকে তূর্যনিনাদ হিসেবে দেখা হয়।
নিজের দেশে রিফিউজি হয়ে বাঁচার যন্ত্রণা কতটা পীড়াদায়ক, মাহমুদ দারবিশ তার আইডেন্টিটি কার্ড কবিতায় সেই অভিব্যক্তি তুলে ধরেন,
"লিখে রাখো!
আমি একজন আরব
এবং আমার পরিচয়পত্রের নম্বর পঞ্চাশ হাজার
আমার আটটি সন্তান
আর নবমটি পৃথিবীতে আসবে গ্রীষ্মকালের পর
তোমরা কি ক্ষুব্ধ হবে তাতে?
লিখে রাখো!
আমি একজন আরব।"
মাহমুদ দারবিশকে বলা হয় ‘যুদ্ধমাঝে শান্তির দূত’। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বিশ্ববিবেকের সামনে যেমন ফিলিস্তিনিদের জাতীয় মুক্তির জোরালো দাবি তুলেছেন, তেমনি যুদ্ধ ও খুনের লোহিত ধারার মধ্যে শান্তির সবুজ গালিচার সন্ধান করেছেন সব সময়। মাহমুদ দারবিশ স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিনের স্বপ্ন দেখলেও ইসরায়েলের মানবিক অধিকার অস্বীকার করেননি, বরং তিনি মনে করতেন যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণভাবেই ফিলিস্তিনের জাতীয় মুক্তি সম্ভব। শান্তিপূর্ণ গণজাগরণের এই নীতিই তাঁকে আধুনিক বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে প্রবাদতুল্য গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছে।
দারবিশ তার কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সম্মাননা পেয়েছেন। অনেক আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনের জাতীয় কবির মর্যাদা লাভ করা, স্বদেশের আপামর জনতার হৃদয় উজার করা ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া।
মানুষের মৃত্যু হয় এ কথা সত্য, কিন্তু আদর্শের মরণ হয় না। দারবিশও বেঁচে থাকবেন তার কবিতার প্রতিটি লাইনে হাজারও বিপ্লবী ফিলিস্তিনির অনুপ্রেরণা হয়ে।
তবে মৃত্যুর আগে তিনি স্বার্থকতার সাথে দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন কবি তাঁর শক্তিশালী অস্ত্র কলমের মাধ্যমে কিভাবে নিজের পরিচয়, মাতৃভূমি, দেশ ও জাতির পরিচয়, হারানো শৈশব নিখুঁত অঙ্কনের পাশাপাশি কলম দিয়ে শব্দ তৈরি করে সে শব্দগুলো জোড়া দিয়ে যুদ্ধ করে। পৃথিবী মহাকাল পর্যন্ত শব্দসৈনিক মাহমুদ দারবিশকে মনে রাখবে। যুদ্ধের পরিবর্তে প্রেমের বার্তা দিয়ে তিনি লিখেছেন-
“মেঘকে শুধায় নারী :
আমার প্রিয়কে তুমিই ঢেকে রেখো
আমার পোশাক যে সিক্ত তার রক্তে।”
আজ ফিলিস্তিনও সিক্ত রক্তে,
কিন্ত সেখানে প্রেম, ভালবাসা, মানবতা নেই।
লেখক,
ফাইজুল ইসলাম ফাহিম
আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।