সানজিদা মুনমুন:
প্রতিটি সফল মানুষের ব্যর্থতার গল্প আছে। একবারে কেউ সফল হননি। সফল উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ, লেখক, বিজ্ঞানী – যার কথাই বলা যাক, সবাইকেই ব্যর্থতার কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে সফল হতে হয়েছে। আবার এই সাফল্য পাওয়ার পরও অনেকে আবার ব্যর্থ হয়েছেন। আবারও তাঁরা উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং আবার সফল হয়েছেন। এইসব সফল মানুষের সবার মধ্যেই একটা আশ্চর্য মানসিক শক্তি আর আত্মবিশ্বাস আছে। যত বড় ব্যর্থতার মুখেই তাঁরা পড়েন না কেন – কখনওই কাজ করা বন্ধ করেন না। কখনওই তাঁরা বিশ্বাস হারান না। তাঁদের এইসব ব্যর্থতার গল্প থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। প্রতিটি গল্প থেকেই অনুপ্রেরণা নেয়ার মত কিছু না কিছু আছে। আজ এমন একজন সফল মানুষের গল্প শুনাবো আপনাদের-
মানুষটাকে আমি ২০১২ সাল থেকে চিনি। এখন ২০২১ সাল চলমান। দীর্ঘ নয়টি বছর একসাথে পথচলা৷ একেবারে কম না সময়টা। একটু একটু করে ভাল বন্ধুত্ব, তা থেকে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। সম্পর্কের ব্যপারটা তার পরিবারে মেনে নিতে পারলেও মানতে পারেনি আমার পরিবার। যার সবচেয়ে বড় কারণ ছেলের পড়াশোনা শেষ হয়নি ও দুজনেই ইম্যাচিউর্ড৷
আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র৷ আমাদের পরিচয়ের শুরু ২০১২ সাল থেকে৷ একটি দুর্ঘটনা মধ্য দিয়েই আমাদের পরিচয়ের সূচনা৷ ২০১২ সালের ২৯ মে ছিল সম্ভবত, যেদিন মানুষটা একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান পা ভেঙে যায়। আর এ দূর্ঘটনার কারনে তার ওই বছরের চলতি সেমিস্টার পরীক্ষা দেয়া বন্ধ হয়ে যায়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকাকালীন প্রথম যেদিন আমি তাকে দেখতে যাই সেদিন প্রথম দেখায় আমার মায়ায় পড়ে যায়৷ দীর্ঘ ৪ মাস পরে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে সে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে৷ আর এই চার মাসেই আমার সাথে তার বেশ ভাব জমে যায়৷ এবার ফিরে এসে দুজনেই বেশ আড্ডায় দিন কাটাতে লাগলাম। প্রায়ই তার সাথে দেখা করা, সাথে ফোনের যোগাযোগ তো ছিলই।
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে প্রথম বার এডমিশন পরীক্ষায় অকৃতকার্জ হই আমি৷ বেশ পরিশ্রমও করেছিলাম কিন্তু ভাগ্যে ছিলো না সে বার। তবে এতে আমি ভেঙে পড়িনি। ২০১৫ সালে পূনরায় এডমিশন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে গেলাম৷ আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে অনুপ্রেরনা ছিল দুজন মানুষ। একজন আমার মা আর দ্বিতীয়জন এই সাদাসিদে মানুষটা। যার প্রতি প্রচন্ড ভাললাগা ও ভালোবাসা৷
এভাবে ধীরে ধীরে আমরা সম্পর্কটাকে সামনে এগিয়ে নিতে থাকি। কিন্তু দুজনই আমরা বেশ আবেগী হয়ে নিজেদেরকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেই৷ রিটেকের পর রিটেক, একটা সময় এসে তো তাকে রি-রিটেক দিয়েও পাশ করতে হয়েছে।
সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনে এ ভর্তি হয় ২০১০ সালে। ২০১০-১১ সেশনে ভর্তি হয়ে অনার্স পাশ করে বের হোন ২০১৬-১৭ সেশনের সাথে। যেখানে তার সহপাঠী বন্ধুরা ২০১৬ সালে মাস্টার্স শেষ করে। অথচ তার অনার্স করতেই লেগে যায় প্রায় ৬/৭ বছর। তাও আবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এরমধ্যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখি ২০১৫ সালে। তাকে আমি যখনই জিজ্ঞাসা করতাম রেজাল্টের কি খবর, সে কিভাবে যেন এড়িয়ে যেত। আমিও বেশি ঘ্যান ঘ্যান করতাম না সি.জি.পি.এ. নিয়ে৷ একসময় জানলাম তার রেজাল্ট পাবলিশড৷ শুধু বলতো পাশ করছে। খোজ নিয়ে জানতে পারলাম সে ২.৫১ নিয়ে পাইছে৷ মাস্টার্স নেই সাথে অনার্সে দুর্বল সি.জি.পি.এ.। বেশ চিন্তার পড়ে গেলাম। এ রেজাল্ট দিয়ে ভবিষত জীবনে কি হবে? নূন্যতম যে সি.জি.পি.এ. দরকার হয় সরকারি চাকুরিতে আবেদনের জন্য ঠিক তার থেকে সামান্য বেশি ৷
এবার তার চাকরি প্রস্তুতি নেয়া শুরু। এরপর চাকুরি পরীক্ষাগুলো দিতে থাকেন। কাছের কিছু বড় ভাই যারা চাকরী পেশায় বেশ সফল, তাদের থেকে পরামর্শ তাকে বেশ উৎসাহ যোগায়। একটা সময় সে ব্যাংক বিসিএস পাশাপাশিই প্রস্তুতি নিতে থাকে। এর পাশাপাশি সে টুকটাক টিউশনি করে নিজের হাত খরচ ও থাকা-খাওয়ার খরচ চালাতে থাকে।
হঠাৎ সে একটা ব্যাংকের প্রিলি পরীক্ষা টিকে যায়। এরপর সে প্রিলির পর লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ন হয়। ভাইবা নিয়ে তার সবচেয়ে উদ্বেগ কাজ করত তার মাঝে। কারন তার রেজাল্ট খারাপ, এটা একটা বিষয় অন্যদিকে তার মাস্টার্স করা নেই। তার কিছু কাছের বড় ভাই যারা খারাপ রেজাল্ট নিয়েও ভাল চাকুরি করছে তাদের থেকে পরামর্শ নেন। তারা তাকে অনেক সাহস যুগিয়েছেন।
আমিও তাকে বেশ সাহস দিয়েছি এ ব্যাপারে৷ অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিন এল ৷ ১৯শে আগস্ট ২০১৯ সাল, তার প্রথম সরকারি চাকরি। যেটা মেরিট লিস্ট থেকেই বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক(অফিসার জেনারেল), এরপর রুপালী ব্যাংক (অফিসার ক্যাশ)।
এবার আসি বিসিএস সফলতার গল্পে৷ বিসিএসেও তার সাফল্য নেহাত কম নয়। ৩৮ তম বিসিএস ছিল তার প্রথম বিসিএস। যেটা তার অনার্স পাশের পরে পাওয়া। সেখানে ক্যাডার হয়তো আসেনি তবুও নন ক্যাডারে প্রথম শ্রেনীর একটা চাকুরি(কারিগরি ইন্সট্রাক্টর ননটেক ম্যাথ)৷ ৪০তম বিসিএসের ভাইভা স্থগিত রয়েছে। সবশেষে তার সবচেয়ে পছন্দের চাকুরি যেটা বিসিএসের থেকেও তার প্রিয় ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ যাকে বিসিএসের মতোই সোনার হরিণ বলা চলে এ দেশে৷ ১১ই ফেব্রুয়ারী সেই সু-সংবাদটা এসেই গেল৷
বর্তমানে সে কৃষি ব্যাংক থেকে চাকুরিতে অব্যাহতি নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের জন্য৷ এরমাঝে সে যে শাখায় চাকুরির সময় কাটিয়ে এসেছে সেখানেও মানুষের এত কাছ থেকে সেবা দিয়েছে যা তারা আজীবন মনে রাখবে৷
সু়খের পথ কখোনোই মসৃণ হয় না। বহু কষ্টে সেটাকে অর্জন করতে হয় এবং নিজের ভাগ্যের কারিগর যে একজন মানুষ নিজেই হওয়া সম্ভব এটা আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। এমন অনেক কষ্টের দিন তার জীবনে গিয়েছে যখন সামান্য টাকাও তার কাছে দুর্লভ ছিল। সাধারনত একটা ছেলের পক্ষে টাকা ছাড়া চলা যে কতটা অসহায়ের সেটা আমি মানুষটাকে দেখে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তার সিনিয়র, জুনিয়র, বন্ধুদের কাছে সে আজীবন ঋণী। কেননা তারা এই অর্থনৈতিক সাপোর্ট না করলে সত্যিই দিনগুলো কিভাবে পার হতো তা জানা নেই।
একটা মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রম। বলতেই হবে পরিশ্রম কখনো বিফলে যায় না এ বাণী চিরন্তন সত্য৷ যে মানুষটা আড্ডা ছাড়া কিছুই বুঝতো না, পরবর্তীতে সে মানুষটা দিন রাত টিউশনি করিয়ে কষ্ট করে চলতেন। নিজস্ব ভাড়া বাসা থাকা সত্তেও হলের রিডিং রুমের বেঞ্চে ঘুমিয়ে রাত পার করে চাকুরির প্রস্তুতি নিয়েছেন।
মা-বাবা সকলের দোয়ায় আজ সে একজন সফল ব্যাংকার৷ আমাকে সে সবসময় একটা কথাই বলেছে, যে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সি.জি.পি.এ./মাস্টার্স কখোনোই মুখ্য হতে পারে না। মুখ্য হলো তার অক্লান্ত পরিশ্রম, নিরলশ চেষ্টা, ধৈর্য আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি ৷
এতক্ষন আপনারা যার গল্প শুনলেন সে আমার একজন সার্থক বন্ধু, ভালবাসার মানুষ এবং স্বামী
এস.এম.আজিজুর রহমান (অফিসার জেনারেল-২০২১ ব্যাচ), বাংলাদেশ ব্যাংক৷
আমি সত্যিই ধন্য। এমন একজন সফল মানুষের পাশে থেকে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনেহয় সবসময়৷
লেখিকা,
তারই সহধর্মীণী সানজিদা মুনমুন,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের গনিত বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী।