ফেস দ্যা পিপল এর জনপ্রিয় লাইভ টকশো অনুষ্ঠানে নিহত মোসারাত জাহান মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বলেন, ‘আমার বোন পাচ ওয়াক্ত নামাজী ছিল। তাহাজ্জুদ পড়তো। আমার এই বয়সেও আমি তাহাজ্জুদ পড়ি না। একটা নামাজী মেয়ে কি আত্মহত্যা করতে পারে? ওকে প্ররোচনা দেয়া হয়েছে। ও অনেক আবেগী ছিলো।’

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক সাইফুর রহমান সাগর। অনুষ্ঠানটিতে আরো উপস্থিত ছিলেন আমাদের কুমিল্লার সম্পাদক শাহাজাদা এমরান।

তিনি আরও বলেন, মুনিয়া আনভীরকে (বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর) অনেক ভালোবাসতো। আনভীর ধোকা দিতে পারে, কিন্তু আমার বোনের ভালোবাসাতো পিউর ছিলো, পবিত্র ছিলো। আমার বোনের টাকা পয়সার লোভ ছিলো না। সে মনেপ্রাণে আনভীরকে ভালোবেসেছিল। সে এতোই নিষ্পাপ ছিলো যে, লুচ্চামি জিনিসটা সে বুঝেনি। সে তাকে বিশ্বাস করেছে। আনভীর তাকে ধোঁকা দিয়ে (বিয়ের কথা বলে) ইউজ করেছে। এর আগে সে তাকে বিয়ে করে বিদেশে নিয়ে রাখার ওয়াদা করেছিল।”

১. নুসরাত জাহান তানিয়ার প্রারম্ভিক বক্তব্য:

রবিবার নয় সোমবার সকাল ৯ টায় মুনিয়ার সাথে কথা হয়, ফোনে মুনিয়া বলেন, আমাকে আনভির ধোকা দিছে, আমি অনেক বিপদে আছি, তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আসো, আমাকে নিয়ে যাও। এরপর ১১টায় আবার ফোন দেয় মুনিয়া, সে বলেন, আপু তোমরা কোথায়? তোমরা তাড়াতাড়ি না আসলে অনেক বড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমরা আসো। ২. বিকাল ৪.১৫ মিনিটে মুনিয়ার গুলশানের ভাড়া বাসায় পৌঁছাই। দরজায় নক করে সাড়া না পেয়ে ফোন করি। তাতেও সাড়া না পাওয়ায় মিস্ত্রি ডেকে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ দেখি। লাশটি ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলেও তার পা দুটি হালকা বাঁকা হয়ে বিছানায় স্পর্শ করা ছিলো এবং বিছানা পরিপাটিভাবে গোছানো ছিল।

২. প্রশ্ন: আপনারা আনভিরকেই কেন সন্দেহ করছেন, আপনাদের কাছে কি প্রমাণ আছে?

তানিয়া: সব প্রমাণ ওই বাসাতেই ছিল এবং গত দুইমাস আগে আনভিরের সাথে সম্পর্ক নিয়ে আমার সাথে মুনিয়ার বাকবিতন্ডা হয়, ওই সময় মুনিয়া জানায় ঢাকায় গিয়ে তাকে আনভির বিয়ে করবে তবে সেটি গোপনে এবং বিয়ের কিছুদিন পর মুনিয়াকে বিদেশে স্যাটেল করবে। আমি বলি, নাহ এটা হয়না; তবে আমি তাকে বোঝাইতে পারি নাই। আমি অনেক চেষ্টা করেছি তাকে বোঝাতে তবে সে আমার কথা মানে নাই। আমি তাকে ফোনেও এই ব্যাপারে অনেক বোঝাইছি, আমার ফোনকল যদি পুলিশ বের করে তাহলে সব পাবে। আমি শেষ পর্যন্ত পারি নাই কারন মুনিয়া আনভিরকে অনেক ভালোবাসতো কিন্তু আনভির ভালোবাসার অভিনয় করেছে। এর বড় প্রমাই মুনিয়ার হাতে লেখা ডায়েরীগুলো।

৩. প্রশ্ন: ডায়েরীতে এমন কি লেখা ছিলো যেটা উল্লেখ করার মতো এবং মুনিয়ার মৃত্যু আনভিরের প্ররোচণা হয়েছে, সেটি কিভাবে প্রমাণ দিবেন?

তানিয়া: হানড্রেড পারসেন্ট আনভিরের হাত আছে, ওই বাসায় নিয়মিত তার যাতায়াত ছিলো, মুনিয়া তাদের সম্পর্ক নিয়ে তার ডায়েরীতে অনেক লেখা লিখে গেছে, মুনিয়ার ফোনে তাদের প্রচুর ছবি আছে, পুলিশের কাছে সব দেওয়া আছে, সব প্রমাণ হবে। আমার কাছে মনে হয়, মুনিয়া বিয়ের চাপ দেওয়াতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং আনভির তাকে বিভিন্নভাবে মানসিকভাবে অত্যাচার করে আসছিলো।

৪. প্রশ্ন: আনভিরের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে আপনারা পারিবারিকভাবে জানতেন? আপনার বাবা মা কি জীবিত আছেন এখনো?

তানিয়া: আমার বাবা ২০১৫ সালে সেপ্টেম্বর মাসে মারা যান এরপরে ২০১৮ সালে এপ্রিলে মা অসুস্থ হয়ে জুনে মারা যায়। আর মুনিয়া আনভিরের সম্পর্কের বিষয়টা আমি জানতাম তবে বরাবরের মতোই আমি তাকে নিষেধ করেছি; তবে আনভির অভিনয় করলেও মুনিয়া তাকে অনেক ভালোবাসতো তাই কখনোই আমার কথা সে শোনে নাই। আরেকটা ব্যাপার হলো, আনভির বিবাহিত ছিলো এ ব্যাপারে জানতাম ।

৫. প্রশ্ন: ফাঁস হওয়া ফোন রেকর্ডটি সম্পর্কে কি বলবেন? এবং আরেকটা বিষয় দেখা যাচ্ছে অভিনেতা বাপ্পীর সাথে আপনার বোনের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, এ ব্যাপারে কি বলবেন?

তানিয়া: ফোন রেকর্ডটিতে যে টাকার কথা হয়েছে এটি সম্পূর্ণ ভূয়া।আমার বোনের টাকার প্রতি কোন লোভ ছিলো না তবে আনভির টাকার বিষয়টা সামনে এনে মুনিয়াকে দূরে ঠেলে দিতে চাচ্ছিলো বলে আমার মনে হয় এবং বাপ্পীর সাথে সম্পর্কের বিষয়টি পুরোপুরি বানোয়াট, কেউ এগুলো রটাচ্ছে। একজনের সাথে পরিচয় মানুষের থাকতে পারে তার মানে এটা না যে তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। আমার বোন চলে গেছে, এখন তার চরিত্র নিয়ে অনেক কথা শোনা যাবে, আমি এটা জানি। একটা মেয়ে যখন কোন সম্পর্কে জড়ায় তখন মানুষ তার চরিত্র ছাড়া আর কিছু খুঁেজ পায়না।

আমার বোন চলে গেছে, আমার সন্তান চলে গেছে। আমি বিচার চাচ্ছি, চরিত্র তার ব্যাক্তিগত বিষয়, যারা তাকে নিয়ে কথা বলছে, পারলে প্রমাণ করুক তার চরিত্র খারাপ ছিলো। এই রমজান মাসে তাকে মাইরা ফেলছে নয়তো মরতে বাধ্য করছে, যেটাই করুক সেটার বিচার চাই এবং এই কাজটা কে করছে সেটার সুষ্ঠু তদন্ত চাই আমি আপনাদের কাছ থেকে। আমার বাপ মা হারা বোন!

৬. প্রশ্ন: আপনার বক্তব্য অনুযায়ী মুনিয়ার মৃত্যুটি হত্যাকান্ড বলে মনে হচ্ছে, আসলেই আপনি কি এটাকে হত্যাকান্ড বলবেন?

তানিয়া: হ্যা, আমার কাছে মনে হচ্ছে হত্যা। আমার বোন ৫ ওয়াক্ত নামাজি ছিলো, তাহাজ্জুতের নামাজ পড়তো, ওর বয়সে আমিও পড়তাম না; আমার এই বয়সেও আমি পড়িনা। একটা মেয়ে যখন ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে কিভাবে সুইসাইড করে। যদি সুইসাইড করেও থাকে তাহলে এমন ভাবে অপমান করা হইছে যে, সে সুইসাইড করতে বাধ্য হইছে।

৭. প্রশ্ন: গুলশানের বাড়ীটির সিসি ক্যামেরায় কি আনভিরের যাওয়া আসার কোন ফুটেজ পাওয়া গেছে?

তানিয়া: হ্যা আনভির যে যাওয়া আসা করতো তার প্রমাণসহ সিসি টিভি ফুটেজ পুলিশের কাছে আছে। আনভির মুনিয়াকে মঙ্গলবার ঘুরতেও নিয়ে গিয়েছিলো সেটারও ফুটেজ আছে। ওই বাড়ীর সিকিউরিটি গার্ডও বলেছিলো পুলিশকে, মঙ্গলবার তাদের একসাথে বাইরে যেতে দেখেছেন।

৮. প্রশ্ন: গতকাল ঢাকা থেকে আজ কুমিল্লায় আসা পর্যন্ত বসুন্ধরা গ্রæপের কেউ কি আপনাকে ফোনে হুমকি ধামকি কিংবা মামলা দিতে কোনভাবে বাধাগ্রস্থ করেছে কি?

তানিয়া: নাহ সেরকম কেই হুমকি কিংবা মামলা দিতে বাধাগ্রস্থ করেনি তবে আমার ফোনে অনেক অচেনা নম্বর থেকে ফোন এসেছে সেগুলো আমি রিসিভ করিনি। এর মধ্যে কিছুক্ষণ আগে একটা ফোন দিয়ে আমাকে কটুক্তি করেছে, আমাকে আজেবাজে কথা বলেছে, আমি নাকি বোনকে দিয়ে ব্যবসা করি। টাকার জন্য আমি এসব করেছি।

৯. প্রশ্ন: বিভিন্ন পত্রিকায় এসেছে, আনভির দেশে নেই তার দুবাই চলে যাওয়ার ব্যাপারে আপনি জানেন কিনা?
তানিয়া: নাহ এ ব্যাপারে আমি জানি না। হ্যা তবে কিছুদিন আগে আমার বোন আমাকে বলেছিলো, তানভির ২৭ তারিখ দুবাই চলে যাবে, ও যাবার পরেই আমি কুমিল্লা চলে আসবো। তবে এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানিনা, যেহেতু রোজা তাই মুনিয়াকে বলেছি, হ্যা, চলে আসো। জনগণ ও সরকারের কাছে আমি এর সঠিক বিচার চাই। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, অনেক সৎ ছিলেন। আমাদের শহরের সবাই জানে আমার বাবা মা কেমন মানুষ ছিলেন, এমন মানুষের এতিম সন্তানকে যে হত্যা করলো তাদের তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার চাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বাংলাদেশের সবকিছুর ঊর্দ্ধে, আমি আপনাদের মাধ্যমে তার কাছে আমার বোনের অপমৃত্যুও বিচার ভিক্ষা চাই। আপনাদের কাছে আমার এটাই আবেদন।

আইএ/